চাল-লিচুর ঐতিহ্যের জেলা দিনাজপুর

চাল-লিচুর ঐতিহ্যের জেলা দিনাজপুর


আজিজুর রহমানঃ
ঐতিহাসিক রূপরেখায় দিনাজপুর একটি অতি প্রাচীন জেলা। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই চমকপ্রদ। নবাবী আমল থেকে ব্রিটিশ শাসন আমল এবং পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত এই জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি বহুলাংশে বিস্তৃতি লাভ করে।সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ভারত ছাড় আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বগাথা এই জেলার ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।


দিনাজপুর জেলায় অসংখ্য কৃতী ও স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে।সাঁওতালসহ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস সেই প্রাচীনকাল থেকেই। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধ করেছে দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে। রাজনৈতিক সব আন্দোলনের অগ্রভাগেই ছিল দিনাজপুরের অসংখ্য বীর সেনানী।


দিনাজপুরের জমি অত্যন্ত উর্বর। দিনাজপুরের যে ক’টি নদী আছে তা দিনাজপুরের শস্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।


বাঙালিদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাত আসে চাল থেকে। দিনে অন্তত একবার যদি ভাত না খাওয়া হয়, তাহলে যেন সারাদিনে খাওয়াই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই বলে কি সবসময় সাধারণ ভাতের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে? গৎবাঁধা খাবারে অরুচি ধরে যাবে না? এই অরুচি কাটানোর জন্য আমরা অন্যান্য আরো সুস্বাদু খাবার খাই। সেসব খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো- বিরিয়ানি, খিচুড়ি, তেহারি, এমনকি ফ্রায়েড রাইস।এই খাবারগুলোর প্রধান উপকরণ হলো চাল। বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি চাল দিয়েই রান্না করা হয় এসব সুস্বাদু খাবার।
সুগন্ধি ধান/চাল উৎপাদনে দিনাজপুর জেলা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ জেলায় নানাজাতের সুগন্ধি ধান জন্মে। তন্মধ্যে ব্রিধান-৩৪, কাটারী, জিরা কাটারী (চিনি গুড়া), ফিলিপিন কাটারী, চল্লিশাজিরা, বাদশা ভোগ, কালোজিরা, জটা কাটারী, চিনি কাটারী, বেগুন বিচি ও ব্রিধান-৫০ উল্লেখযোগ্য। একমাত্র ব্রিধান-৫০ রবি/বোরো মৌসুমে আবাদ হয়। অন্যান্য জাতের সুগন্ধি ধানগুলোর অধিকাংশ খরিপ-২/রোপা আমন মৌসুমে আবাদ হয়।


সুগন্ধি চাল গুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো খেতে সুস্বাদু ও সুগন্ধ ছড়ায়।দিনাজপুরসহ সারা দেশে প্রধান পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, জর্দা, ভুনা-খিচুড়ি, ফিরনি, পায়েশসহ আরও নানা পদের সুস্বাদু ও দামি খাবার তৈরিতে সুগন্ধি চাল বেশি ব্যবহার হয়। বিয়ে, পূজা-পার্বণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের ব্যবহার অতি জনপ্রিয়। অনেক সচ্ছল পরিবারে, বনেদি ঘরে সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি (কাটারিভোগ, বাংলা মতি) সিদ্ধ চালের ভাত খাওয়ার রেওয়াজ অহরহ দেখা যায়।

এছাড়াও চাইনিজ, ইটালিয়ান, ইন্ডিয়ান হোটেল/ রেস্টুরেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল/ মোটেল পর্যটন কেন্দ্রে প্রধানত সুগন্ধি চালের ভাত, পোলাও নানা পদের খাবার পরিবেশনে দিনাজপুরের সুগন্ধি চাল ব্যবহার করা হয়।


দিনাজপুরের সুগন্ধি কাটারিভোগ চাল নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর দরবারে দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রাজার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই একজন সম্রাটের সঙ্গে দেখা করার সময় যে কেউই কিছু উপঢৌকন নিয়ে যায়। রাজাও সম্রাটকে খুশি করার জন্য হীরা, পান্না, স্বর্ণমুদ্রার সাথে কাটারিভোগ চাল নিয়ে যান। সম্রাট আওরঙ্গজেব উপঢৌকন হিসেবে পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন কাটারিভোগ চাল পেয়ে। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিচার করার বদলে সম্রাট প্রাণনাথকে ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।


তবে আবহাওয়াগত পরিবর্তন, কৃষকের ন্যায্য দাম না পাওয়া ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কাটারিভোগ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। তবে বর্তমানে কাটারিভোগ ধান ফিরিয়ে আনতে উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এতে আশাতীত ফলন পাওয়া গেছে। ফলন দেখে কৃষকেরা এ ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
সুগন্ধি চাল ছাড়াও উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ দিনাজপুর জেলাকে লিচুর রাজ্য নামেও পরিচিত রয়েছে দেশ ও বিশ্বব্যাপী। দিনাজপুরে প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে লিচু চাষের জমির পরিমাণ।


দিনাজপুর জেলার লিচু ঢাকাসহ সারা দেশে সরবরাহ হয়ে থাকে।সারা দেশে কম বেশি লিচু চাষ হলেও দিনাজপুরের লিচুর কদর আলাদা।দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে দিনাজপুরের বেদানা চায়না, চায়না থ্রি, বোম্বাই, মাদ্রাজি ও কাঁঠালী লিচুর কদর রয়েছে। রসালো ফল লিচু অনেকের কাছে ‘রসগোল্লা’ হিসেবে পরিচিত।


সীমান্তবর্তী দিনাজপুর জেলা যার পরতে পরতে আছে পৌরাণিক কাহিনী, রাজ-রাজরাদের ইতিহাস আর আছে নিজস্ব কিছু সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যমন্ডিত ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ তা একান্তই আপন।

আপনি আরও পড়তে পারেন