ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সোপান মহেড়া জমিদারবাড়ী

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সোপান মহেড়া জমিদারবাড়ী

মোঃ আব্দুর রহীম মিঞা:

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সোপান হয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মহেড়া জমিদারবাড়ী । রাজা- জমিদাররা চলে গেছে ভিটে-মাটি ছেড়ে অনেক বছর আগে। কিন্ত রেখে গেছেন ইতিহাস ও ঐত্যিয়ের চিহ্ন গুলো। প্রাচ্যের অনুপম স্থাপত্যশৈলীর সুনিপুন হাতের নির্মিত দ্বিতল ভবনগুলো ঠায় দাড়িয়ে রয়েছে মাথা উচু করে মহেড়ার জমিদার বাড়ীটিতে।
বৃটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করলে কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহার পুত্ররা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারদের নিকট থেকে একটি অংশ বিপুল অর্থের বিনিমযে ক্রয় করে নেন। ১৮৯০ সালে চার ভাই মিলে জমিদারীর গোড়া পত্তন করেন। । শুরু হয় জমিদারী শাসন। মহেড়া জমিদাররা ছিলেন সাহা বংশের । বংশীয়ভাবে ছিলেন বুনেদী ব্যবসায়ী। তারা ছিলেন বুদাই সাহা, বুদ্ধু সাহা, হরেন্দ্র সাহা , কালীচরণ সাহা। পরে সাহা বংশ থেকে পরবর্তী প্রজন্ম সবাই রায় চৌধুরী পদবী গ্রহণ করেন।
প্রায় ৮ একর বা আঠাশ বিঘা জমির উপর গড়া মহেড়া জমিদারবাড়ীটি। এখানে ১৮৯০ সালে নির্মিত মহারাজ লজ, চৌধুরী লজ, আনন্দ লজ, এবং কালীচরণ লজ নামে চারটি স্থাপত্যশৈলীর সুনিপুন কারুকাজের দৃষ্টি নন্দন দ্বিতল ভবন রয়েছে। জামিদার বাড়ীর স্থাপনাগুলোর মধ্যে চৌধুরী লজের অবস্থান ঠিক পূর্ব পার্শ্বে । ভবনটিতে রয়েছে সুপরিসর ছয়টি কক্ষ। এখানে বাস করতেন জমিদার সুধীন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী। প্রাচ্যের স্থাপত্যশৈলীর অনুপমে নির্মিত আনন্দ লজ ভবনটিতে ১২টি কক্ষ রয়েছে। ধারনা পাওয়া যায় স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে নির্মিত ভবনগুলো নির্মাশৈলি রোমান,মোঘল,সিন্দু খেকুদের সাথে মিল রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কালের স্বাক্ষী দৃষ্টিনন্দন মহেড়া জমিদার বাড়ীটি। এ ভবনে বাস করতেন বকুল রায় চৌধুরী ।
জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহারাজ গিরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী। তিনি ব্রিটিশ আমলে সম্মানিক বিচারক এবং একাধারে নীতিবান প্রজাবৎসল মানুষ ছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে।
জমিদার তরফের সন্তানেরা শুধুমাত্র বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক ছিলেন না, তাদের ছিল সুবিশাল চিত্র । কালীচরণ সাহা ও আনন্দমোহন সাহার উত্তরাধীকারি রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পর্যায়ক্রমে জমিদারী পরিচালনা করেন। বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে জমিদার শাসন বাতিল হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মূল জমিদারদের অধিকাংশই ভারতে চলে যান।
মহেড়া জমিদারগনের ছিল বিশাল বিশাল স্থাপনা। জমিদারদের সুবিশাল কর্মকান্ডের ব্যবস্থাপনার জন্য গড়ে উঠেছিল নায়েব ভবন, কাছারি ভবন, গোমস্তা ভবন প্রভূতি স্থাপনা । তিন কক্ষ বিশিষ্ট কাছারি ভবনের স্থাপত্য শৈলীও দশর্নার্থীদের মন-প্রাণ আকুল করে তোলে। জমিদার কুলের নায়েব গোমস্তারা প্রভূতি দাপ্তরিক ব্যক্তিবর্গ এসব ভবনে বসে দাপ্তরিক কাজ-কর্ম সারতেন।
মহেড়া জমিদার বাড়িিটতে রয়েছে কাছারি বাড়ী, যেখানে বসে খাজনা আদায় করা হতো। আরো আছে কর্মচারী, আতœীয় স্বজনদের থাকার ঘর এবং প্রার্থনার মন্দির। জমিদার বাড়ীর সামনে রয়েছে বিশাখা সাগর নামে বড় এক দীঘি। পিছনে রয়েছে পাসড়া পুকুর ও রাণী পুকুর । বাড়ীতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২ টি সুরম্য গেট ।
নিভূত পল্লীতে ছায়াঘেরা পাখির কলোকাকলীতে মুখরিত নির্মল নির্ঝর শান্ত পরিবেশে জমিদারবাড়ী আকুল করে দর্শনার্থীদের। চারিদিকে মনোরম পরিবেশ প্রাচ্যের স্থাপত্যশৈলির কারুকার্য একবার নয় দ’ুবার নয় বারবার হাতছানী দিয়ে ডাকে দেশি-বিদেশী দর্শনার্থীদের। চারদিকে নানা বৈচিত্র্যের ফুলের বর্ণ ও গন্ধের সমারোহ যেন নিবেদিত পুষ্পার্ঘ্য।
এলাকার মানুষের সামগ্রিক কল্যানের কথা চিন্তা করে মহেড়ার জমিদাররা গড়ে তোলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মন্দির। তার মধ্যে রয়েছে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত মহেড়া আনন্দ কুমার রায় চৌধুরীর নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয়। রয়েছে গোপিনাথ জিওর বিগ্রহ মন্দির, শ্রী শ্রী শ্মঁশাণ কালী মন্দির । বর্তমানে মহেড়া জমিদার বাড়ীটিতে দর্শনার্থী গিরে গড়ে তোলা হয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা । চিড়িয়াখানায় রয়েছে ময়ুর, হরিণসহ কয়েক ধরনের প্রাণী। রয়েছে শিশুদের জন্য বিনোদনে নাগরদোলাসহ নানা রকম খেলার সামগ্রী। পাসরা পুকুরে রয়েছে মনোরম দৃশ্যের একটি পানির ফোয়ারা। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সুশোভিত ফুলের বাগান।
জমিদার বাড়ীটির আনন্দ লজ ভবনটির ভিতরে শোভা পাচ্ছে ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ বাহিনীর সদস্যের ট্রেচু, মিউজিয়াম, জমিদারদের ব্যবহৃত , পানদানি কৌটা, সিদুর কৌটা, ঘটি-বাটি,একনালা-দোনালা বন্দুকসহ বিভিন্ন ব্যবহৃত সরঞ্ছাম।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় এই জমিদার বাড়ী গিরে রয়েছে এক কলকিèত স্মৃতি চিহ্ন । ১৯৭১ সালের ১৪ ই মে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী মহেড়া জমিদার বাড়ীতে হামলা করে এবং জমিদার বাড়ীর কুলবধু যোগমায়া রায় চৌধুরীসহ পাঁচজন গ্রাম বাসীকে চৌধুরী লজের মন্দিরের পেছনে একত্রে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তন্মধ্যে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক পন্ডিত বিমল কুমার সরকার, মনিন্দ্র কুমার চক্রবর্তী, অতুল চন্দ্র সাহা, এবং নোয়াই বনিক ছিলেন। ইতিহাস কলঙিকত রক্তের সেই দাগ এখনো লেগে আছে মহেড়া জমিদার বাড়ীতে। প্রাক বাহিনীর এই চরম হত্যাযজ্ঞে জমিদার পরিবার শুধু হতাশ হননি , শত বছরের জমিদারি ও জমিদার বাড়ীর অডেল সম্পদ ফেলে চরম ঘৃণা নিয়ে লৌহজং নদীর নৌপথে নৌকা যোগে চলে যান এদেশ ছেড়ে ।
মহেড়া জমিদার বাড়ী সভ্যতা আর ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন। অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য আর বিশাল মহলগুলো আজও ঠায় দাড়িয়ে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করছে॥ পুরোনো হাজারো স্মৃতি , সুখ-দুঃখের কীর্তি লেপে আছে এ বাড়ীর প্রতিটি পরত। এই জমিদাররা অন্যান্য জমিদারদের মত অত্যাচারী না হলেও কর্তৃত্বপরায়ন ছিলেন। মহেড়ার জমিদাররা এলাকার উন্নয়নের জন্য অনেক কাজও করেছেন। তবু প্রকৃতির এক অদৃশ্য নিয়মে তাদেরকে এগুলো ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
পুরোনো জমিদারবাড়ীর কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে টাঙ্গাইলে মির্জাপুরের মহেড়া জমিদারবাড়ীর কথা। দেশের সুন্দর সুন্দর জমিদার বাড়ীগুলো এখন শুধু স্মৃতিই বয়ে বেড়ায়।কিছু কিছু জমিদারবাড়ী সংস্কার করা হলেও প্রায় অধিকাংশই ধ্বংসবাশেষ অবস্থায় বিরাজ করছে ।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনাতাযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে জমিদার বাড়ীটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জোনাল পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ মহতী কাজটি করেন তদকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান। ১৯৯০ সালে জোনাল পুলিশ ট্রেনিং স্কুলকে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নতি করা হয়েছে। মহেড়া জমিদার বাড়ীটি এখন মহেড়া জমিদার বাড়ী ও মহেড়া পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার নামে দেশী-বিদেশী মানুষের কাছে সর্বাধীক পরিচিতি লাভ করেছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন