কয়লা হয়ে গেল এতগুলো মানুষ! রূপগঞ্জে লাশ আর লাশ

কয়লা হয়ে গেল এতগুলো মানুষ! রূপগঞ্জে লাশ আর লাশ

রূপগঞ্জে লাশ আর লাশ
জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫৩; রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহলের শোক; ২২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে
কামাল উদ্দিন সুমন নারায়ণগঞ্জ ও শফিকুল আলম ভূঁইয়া রূপগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় সেজান জুসের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। আগুনে লাশ পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যাওয়ায় ৫০ জনের কোনো পরিচয় শনাক্ত হয়নি। তবে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তাদের পরিচয় শনাক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। একের পর এক লাশ উদ্ধারের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে রূপগঞ্জ। স্বজনহারাদের আহজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন শোক প্রকাশ করেছেন।

জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত্র হয় বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায়। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২২ ঘণ্টা চেষ্টার পর গতকাল শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরই মধ্যে বেলা ১টার দিকে কারখানাটি থেকে বের করে নিয়ে আসা হয় একের পর এক লাশ। পরে পোস্টমর্টেম করার জন্য লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে স্বপ্না রাণী (৪৫) ও মিনা আক্তার (৩৩) নামে দু’জন নারী শ্রমিকের লাশ উদ্ধার হয়। পরে রাতে মারা যায় শ্রমিক মোরসালিন (২৫)। শুক্রবার দুপুরের দিকে একে পর এক লাশ উদ্ধার হতে থাকে।

 

শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কর্মচারী কাজ করেন। সাততলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচতলার একটি ফ্লোরের কার্টন থেকে হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ সময় আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।

এ সময় কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। একপর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। আবার কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফ দেন। এ সময় ঘটনাস্থলেই রানী ও মিনা আক্তার নামে দুই নারী নিহত হন। পরে মারা যায় মুরসালিন। ভবনটি চতুর্থ তলার সিঁড়ির গেট বন্ধ থাকায় সেখান থেকে কোনো শ্রমিক বের হতে পারেনি। ওই ফ্লোর থেকে বেশির ভাগ লাশ উদ্ধার হয়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, আগুনের ঘটনায় কতজন নিখোঁজ আছেন তার একটি তালিকা প্রস্তুত করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সেই তালিকা তৈরির কাজ চলছে। স্বজনদের দাবি অনুযায়ী নিখোঁজদের নাম তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে। একই সাথে যারা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাধীন রয়েছে তাদেরও একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট এখনো একযোগে কাজ করে। কিন্তু কারখানাটির আশপাশে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব হয়। কারখানাটির ওপরের ফ্লোরগুলোতে প্লাস্টিকসহ দাহ্য পদার্থ থাকায় বারবার আগুন জ¦লে উঠছে। প্রায় ২২ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফ্লোর তালাবদ্ধ থাকায় বেড়ে যায় নিহতের সংখ্যা : সেজান জুসের কারখানায় আগুন লাগার সময় ভবনের চতুর্থ তলার সিঁড়ি গেট তালাবদ্ধ থাকায় শ্রমিকরা কেউ বের হতে পারেনি। এতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। তারা জানান, ফ্লোর তালাবদ্ধ না থাকলে এত প্রাণহানি হতো না। কারখানায় বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

 

ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, অগ্নিকাণ্ডের সময় অনেক ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। এখনো বহু শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। তবে কারখানার একটি সিঁড়ি বন্ধ না থাকলে অনেক প্রাণ বাঁচানো যেত বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন। ঘটনাস্থলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা গাড়ির মই সেট করে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। বাকিরা যদি ছাদে উঠতে পারত, আমরা কিন্তু বাঁচাতে পারতাম।’
দেবাশীষ বর্ধন আরো বলেন, চতুর্থ তলায় যারা ছিলেন, ‘সেখান থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি তালাবদ্ধ ছিল। আর নিচের দিকে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ছিল ভয়াবহ আগুন। উনারা নিচের দিকেও আসতে পারেন নাই, তালাবদ্ধ থাকায় উনারা ছাদেও যেতে পারেন নাই।’
ডিএনএ টেস্টের মাধ্যম্যে শনাক্ত হবে লাশের পরিচয় : অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের লাশ দেখে চেনার উপায় নেই। ডিএনএ পরীক্ষার ভিত্তিতে স্বজনদের কাছে তা হস্তান্তরের কথা জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুবাস চন্দ্র সাহা শুক্রবার দুপুরে বলেন, এখন পর্যন্ত যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের শরীর এতটাই পোড়া যে লাশ দেখে চেনার উপায় নেই। ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে লাশগুলো রাখা হবে। স্বজনদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হবে।
৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি : অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসন। ঢাকা নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম ব্যাপারী বলেন, তাকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি এবং এতে কারও দায় ছিল কি না, এসব বিষয় দেখা হবে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা এবং আহত ব্যক্তিদের ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হবে।

আগুন নেভাতে বিলম্বে ভাঙচুর : দীর্ঘ সময়েও রূপগঞ্জের সেজান জুস ফ্যাক্টরির আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছেন স্থানীয়রা। হামলায় ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যরাও আহত হন। এ সময় হামলাকারীরা কারখানার গেটের সাথে থাকা আনসার ক্যাম্পেও হামলা চালায় ও তিনটি শটগান ছিনিয়ে নেয়। পরে দু’টি শটগান উদ্ধার করা হলেও একটি শটগান উদ্ধার করা যায়নি। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় হামলাকারীরা কারখানার অভ্যন্তরে থাকা বেশ কিছু গাড়ি ও মোটরসাইকেলেও ভাঙচুর চালায়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আগুন লাগার পর থেকে স্থানীয় লোকজন আগুন নেভাতে চাইলে গেটের সামনে সিকিউরিটি গার্ডরা দুর্ব্যবহার করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় চলে যাওয়ার পরও আগুন নেভাতে না পারায় সকালে নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। পরে তারা কারখানায় হামলা চালান। এ সময় তারা কারখানার প্রশাসনিক ভবনের জানালার কাচ, দরজা একটি প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ভাঙচুর করে। এ সময় তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ও ট্রাক ভাঙচুর করে।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম জানান, স্থানীয় উৎসুক জনতা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। পরে পুলিশ তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
৩০ শ্রমিককে বাঁচালেন তাজুল : পুড়ে যাওয়া ভবনটিতে প্রায় ১৭ শ’ শ্রমিক কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় ওই ভবনের পঞ্চমতলায় থাকা প্রায় ৩০ জন শ্রমিককে দড়ি দিয়ে ছাদ থেকে নিচে নামিয়ে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাজুল ইসলাম। যার সহযোগিতায় ওই শ্রমিকরা নিরাপদে নামতে পেরেছেন এবং তাদের কেউ আহত হননি।
তবে শ্রমিকদের নামাতে গিয়ে তাজুল ইসলাম নিজেও কিছুটা আহত হয়েছেন। তাজুল ইসলাম ওই কারখানাটির ওই ভবনের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ডিপ্লোমা) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে তিনি ওই ভবনের পাঁচতলায় ইলেকট্রিক্যাল কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে গ্যাসের গন্ধ পেয়ে শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে চার দিকে ছুটতে থাকেন। এ সময় আগুন লাগার খবরে পাঁচতলার শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে ভবনের ছাদে চলে যায়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ওপরে দড়ি পাঠালে তাজুল ইসলাম একাই প্রায় ৩০ জন নারী শ্রমিককে নিচে নামিয়ে আনেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই কাজটি করেছি। আমি নিজেই এখন একটু অসুস্থ। তাই আর আপনাদের সাথে কথা বলতে পারছি না।’
দাহ্যপদার্থ মজুদ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় সেজান জুুসের কারাখানাতে শুধু জুস নয় অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীও তৈরি হতো। দীর্ঘ সময় ধরে আগুনের লেলিহান শিখার কারণে ভবনের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ফাটল। কারখানাটির ভেতরে বিভিন্ন রাসায়নিকসহ দাহ্যপদার্থ মজুদ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসকে। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ লাশই পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে।

জানা গেছে, ভবনের চতুর্থতলায় ললিপপ, তরল চকলেট, তৃতীয়তলায় অরগানিক পানীয় (জুস, লাচ্ছি), দোতলায় টোস্ট বিস্কুট, বিভিন্ন ধরনের পানীয় এবং নিচতলায় বাক্স ও পলিথিন তৈরির কারখানা ছিল। পঞ্চমতলার একপাশে সেমাই, সেমাই ভাজার তেল, পলিথিন; অপর পাশে কারখানার গুদাম ছিল। কারখানার ষষ্ঠতলায় ছিল কার্টনের গুদাম। টানা ২১ ঘণ্টা ধরে আগুনে পুড়ছে পুরো কারখানা।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, কারখানাটির ভেতরে বিভিন্ন রাসায়নিকসহ দাহ্যপদার্থ মজুদ ছিল।

মায়ের হাড্ডিগুলা খুইজ্জা দেন স্যার : গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় হাসেম ফুড লিমিটেডের পুড়ে যাওয়া কারখানার সামনে ফিরোজা বেগমকে (৩৮) প্রথম দেখা যায়। কারখানার প্রধান ফটকের পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন তিনি। চোখেমুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন হালিমার স্বজনেরা। শুক্রবার দুপুরে কারখানার সামনে থাকা নিখোঁজ স্বজনদের ভিড়েও ফিরোজাকে আলাদাভাবে চোখে পড়েছে। সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় ফিরোজা পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন ঘটনাস্থলে আসা ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তার। কখনো হাত কখনো বা পা জড়িয়ে ধরেছেন। বারবার চিৎকার করে বলেছেন, ‘ও স্যার, আমার ’ হালিমা তাঁর নিখোঁজ মেয়েকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। যেকোনো উপায়ে অন্তত সন্তানের লাশটুকু ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন তিনি।

ফিরোজার জন্ম কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায়। বাবা বাচ্চু মিয়া দিনমজুর। সংসারের অভাব ঘোচাতে পাঁচ বছর আগে মাত্র ১১ বছর বয়সে হাসেম ফুডের কারখানাটিতে শ্রমিকের কাজ নেয় তাসলিমা। পাঁচ বছর পর এসে তাসলিমার বেতন দাঁড়িয়েছিল ৫ হাজার ৬০০ টাকা। ফিরোজা নিজেও এই কারখানার শ্রমিক। মেয়ের আগে থেকেই কারখানার দোতলায় টোস্ট শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। গতকাল আগুন লাগার সময়েও মা-মেয়ে কারখানাটির আলাদা দু’টি তলায় কাজ করছিলেন।

গতকাল দুপুরে সে কথা বলেই বিলাপ করছিলেন ফিরোজা। বিলাপের সুরে তিনি জানান, কারখানায় আগুন লাগার পর জীবন বাঁচাতে কারখানার দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তখনই কারখানার চারতলায় আটকেপড়া মেয়ে তাসলিমার কথা মনে পড়ে। ছুটে যেতে চান কারখানার চারতলায়। কিন্তু কারখানার নিচের ফটক বন্ধ পেয়ে হালিমার আর কারখানার ভেতরে যাওয়া হয় না।
তাসলিমার চাচি আমিনা বেগম অভিযোগ করেন, আগুন লাগার সময় কারখানার নিচের ফটকটি বন্ধ ছিল। এ কারণে অনেক শ্রমিকই কারখানাটি থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।

এটা নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেজান জুসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবুল হাশেম। এ ঘটনার কোনো দায় তার প্রতিষ্ঠান নেবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে আবুল হাশেম বলেন, আগুনের ঘটনার দায় নেবো না। এটা নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা। এই দায় আমার না।
তবে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে বলছেন, কোনো শ্রমিক সিগারেট খেয়ে ফেলে দিয়েছে। সেখান থেকে আগুন লাগতে পারে। যেহেতু নিচের তলায় কার্টন রাখা ছিল এবং বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ ছিল, তাই হয়তো আগুনের এই ভয়াবহতা।
আবুল হাশেম বলেন, আমি এখনো ঘটনাস্থলে যাইনি। তবে আমার লোকজন সেখানে রয়েছে। যারা মারা গিয়েছেন, তারা তো আমারই ছেলেমেয়ে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

স্বজনদের আহাজারি : নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা শান্তামণি (১২) গত দেড় বছর ধরে এখানে চাকরি করে। তার মা শিমু আক্তার মেয়ের খোঁজে বিলাপ করে কাঁদছেন। মাঝে মধ্যেই মূর্ছা যাচ্ছেন। এমনি করেই শ্রমিক পারভেজের (২০) মা ফরিদা, অমৃতার (২৫) স্বামী সেলিম মিয়া, রাবেয়ার (২০) বাবা চান্দু মিয়া, রহিমার (২৯) স্বামী কালাম মিয়াসহ আরো অনেকেই স্বজনদের জন্য আহাজারি করছেন।

তাদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কেউ ছুটছেন স্বজনের খোঁজে। শোকে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কেউবা বাকরুদ্ধ। কেউবা নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন ভবনের পাশে। আবার কেউ কেউ মূর্ছা যাওয়া স্বজনদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম হৃদয়বিদারক দৃশ্য উপনীত হয় আশপাশের পুরো এলাকায়।

নিখোঁজ শ্রমিকদের খুঁজতে আসা স্বজনরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করেন। কেউবা উত্তেজিত হয়ে কারখানার কর্মকর্তাদের খোঁজেন। ঘটনার দিন কর্মরত ছিল তিন হাজার শ্রমিক। তাদের অধিকাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। তারা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। স্বজনরা জানিয়েছেন, এখানে কর্মরত শ্রমিকদের আয়ে চলত তাদের সংসার। এখন অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন যাপন করতে হবে তাদের।

রাষ্ট্রপতির শোক
বাসস জানায়, রাষ্ট্রপতি এম আবদুল হামিদ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ সেজান জুস ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ আগুনে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি দুর্ঘটনায় নিহতদের রূহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। রাষ্ট্রপতি অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত চায় জাপা
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের এমপি। খাদ্যপণ্যের কারখানায় আগুনে পুড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে গতকাল শুক্রবার এক শোকবার্তায় নিহতদের রূহের শান্তি কামনা করেন তিনি। পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।

জামায়াতের শোক
রূপগঞ্জের একটি জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক লোক নিহত হওয়ায় গভীর শোক প্রকাশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান গতকাল এক শোকবাণীতে বলেন, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন আমি তাদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করছি তিনি যেন তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দান করেন। যারা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আমি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।
ঘটনার কারণ উদঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, নিহতদের পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যারা গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং কারখানা কর্তৃপক্ষসহ দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী (ভারপ্রাপ্ত) আবুল হাসান রুবেল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা: মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব লায়ন ফারুক রহমান ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর লেবার পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান খোকন। এ ছাড়া আরো বিবৃতি দিয়েছে, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম-এসএনএফ ও ব্লাস্ট।

আপনি আরও পড়তে পারেন