যে কারণে আগস্টের মধ্যেই আফগানিস্তান ছাড়তে চায় যুক্তরাষ্ট্র

যে কারণে আগস্টের মধ্যেই আফগানিস্তান ছাড়তে চায় যুক্তরাষ্ট্র

আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যেই আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রত্যাহার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যুক্তরাষ্ট্র জোর গতিতে কাজ করছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো কাবুল থেকে প্রত্যাহার প্রক্রিয়া সম্পন্নের সময়সীমা বাড়াতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানালেও বাইডেন সেটি কার্যত কানেই তোলেননি।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানিয়েছেন, কাবুল থেকে প্রত্যাহার প্রক্রিয়া যত তাড়াতাড়ি আমরা শেষ করতে পারি, ততই মঙ্গল। আর এটা বাস্তবায়িত হলে মার্কিন নাগরিক ও সহযোগী আফগানদের নিরাপদে সরিয়ে আনার টানা দুই সপ্তাহের প্রক্রিয়া শেষ হবে আগামী ৩১ আগস্ট।

যেভাবে ৩১ আগস্ট তারিখটি নির্ধারণ হয়
২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ মে’র মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সেনাকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের।

কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন জো বাইডেন।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তালেবানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বাক্ষরিত চুক্তি নিয়ে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশার। পরে গত ১৪ এপ্রিল ট্রাম্পের চুক্তিতে থাকা সেনা প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়সীমা চার মাসের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন বাইডেন।

সেসময় তিনি জানান, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হওয়া জঘন্য হামলার ২০তম বর্ষপূর্তি উদযাপনের আগেই আফগানিস্তান ছাড়বে মার্কিন ও সামরিক জোট ন্যাটোর সেনা সদস্যরা।

এরপর থেকেই মূলত আফগানিস্তানে অবস্থানরত ২ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা, কয়েক হাজার ন্যাটো সেনা সদস্য ও প্রায় ১৬ হাজার বেসামরিক কন্ট্রাক্টরকে নিরাপদে দেশটি থেকে সরিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দেয় বাইডেন প্রশাসন।

সমালোচকরা অবশ্য বরাবরই নাইন-ইলেভেনের হামলার সঙ্গে সময় মিলিয়ে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে আসছিলেন। এরপর গত জুলাই মাসে, আফগান ভূখণ্ড থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা আরও এগিয়ে নিয়ে আসেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সেসময় তিনি জানান, ‘আগামী ৩১ আগস্ট আফগানিস্তানে আমাদের সামরিক অভিযান শেষ হবে।’

সমস্যা কি ছিল?
বার্তাসংস্থা এএফপি বলছে, মার্কিন সেনা-সহ বেসামরিক মার্কিনিদের প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার মধ্যেই তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগান সামরিক বাহিনীকে আরও সংগঠিত করার সুযোগ দিতে কাবুলের আশরাফ গনি সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে ছিল ওয়াশিংটন। এমনকি আগে যেসব সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতো ও যেসব সামরিক সরঞ্জাম মার্কিন বাহিনী ব্যবহার করতো সেগুলোও আফগান বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল দেশটি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলো আশা করেছিল যে, আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী তালেবানকে চূড়ান্তভাবে থামাতে না পারলেও সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটির অগ্রযাত্রায় হয়তো কিছুটা ধীরগতি আনতে সক্ষম হবে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আভাস দিয়েছিল যে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা-সহ সকল বিদেশি সেনা প্রত্যাহরের পর মোটামুটি ছয় মাস কাবুলের ক্ষমতায় থাকতে পারে আশরাফ গনির সরকার।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিশ্বাস ছিল, আফগানিস্তানে অবস্থানরত সকল বেসামরিক মার্কিন নাগরিক এবং বিশেষ অভিবাসন ভিসার (এসআইভি) মাধ্যমে হাজার হাজার আফগান সহযোগী, দোভাষী ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার কাজ সম্পন্ন করতে এই ছয় মাস সময়ই আসলে যথেষ্ট।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই হিসাব ছিল পুরোটাই ভুল। তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগান সামরিক বাহিনী দাঁড়াতে একেবারেই ব্যর্থ হয় এবং সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় প্রায় পুরো আফগানিস্তান নিজেদের দখলে নেয়। পরে রাজধানী কাবুলে প্রবেশের মাধ্যমে গত ১৫ আগস্ট দখল পাকাপোক্ত করে তালেবান।

আর ঠিক তখনই সৃষ্টি হয় চরম বিশৃঙ্খলার। তালেবানের ক্ষমতা দখলের আতঙ্কে হাজার হাজার আফগান নাগরিক দেশ ছাড়তে কাবুল বিমানবন্দরের দিকে ছুটতে শুরু করেন। বিশৃঙ্খলা, হুড়োহুড়ি, সহিংসতা আর গুলিতে এখন পর্যন্ত কাবুল বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে প্রায় দুই ডজন আফগান নিহত হয়েছেন।

বিমানে জরুরিভিত্তিতে সবাইকে আফগান ভূখণ্ডের বাইরে নেওয়া
গত ১৫ আগস্ট সকাল থেকেই আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ঢুকতে শুরু করে তালেবান যোদ্ধারা। ‘আকস্মিক বিপদ’ বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন সামরিক-বেসামরিক ও কূটনীতিক নির্বিশেষে কাবুলের সকল বাসিন্দা। এই পরিস্থিতিতে সবাই ছুটতে শুরু করেন কাবুল বিমানবন্দরে। লক্ষ্য একটাই, যত দ্রুত সম্ভব কাবুল ত্যাগ করা।

বিমানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আগস্টের ১৪ তারিখে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ৬ হাজার সদস্য মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যও মোতায়েন করে প্রায় ৯০০ সেনা সদস্য।

বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, গত ১৪ আগস্ট থেকে মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ কাবুল থেকে ৭১ হাজার মানুষকে বিমানে করে সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ২১ হাজারের বেশি মানুষকে। তবে এরপরও কাবুল বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে দেশ ছাড়তে ইচ্ছুক হাজার হাজার মানুষ এখনও অপেক্ষা করছেন।

যথেষ্ট সময় নেই?
তালেবান প্রায় পুরো আপগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিলেও কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সকল কার্যক্রম এখনও নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন। সংস্থাটি জানিয়েছে, আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত পুরোদমে প্রত্যাহার কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও এই কর্মকাণ্ড এখন কিছুটা স্তিমিত করতে হচ্ছে।

কারণ, কাবুল বিমানবন্দরে দায়িত্বপালন করা ৬ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা, শত শত মার্কিন কর্মকর্তা, বিমানবন্দরে দায়িত্বপালন করা ৬০০ আফগান নিরাপত্তা সদস্য এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়ার দিকেই মূল মনোযোগ দিতে হচ্ছে তাদের।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে দেশগুলো তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাইকে হয়তো সরিয়ে নিতে পারবে না। তাই আগস্ট মাসের পরও আফগানিস্তানে থাকতে যুক্তরাষ্ট্রকে দেশগুলো অনুরোধ জানালেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেকথা কার্যত কানেই তোলেননি।

ওয়াশিংটনে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগান ভূখণ্ডে অবস্থানরত সকল মার্কিন নাগরিককে হয়তো বের করে আনা সম্ভব হবে না। একই আশঙ্কা মার্কিন বাহিনীর সহযোগী, দোভাষী ও তাদের পরিবারের ক্ষেত্রেও। যদিও সেই সংখ্যাটি আসলে কত, তা এখনও পরিষ্কার নয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন