কৌশলে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দখলে ১০ বছর

কৌশলে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দখলে ১০ বছর

জহুরুল ইসলাম, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি :

 

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বাঘাবাড়ি নৌ- বন্দরে ৭ বছর ধরে ইজারা প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় সরকার নতুন করে কাউকে ইজারা দিতে পারছেন না। নতুন করে টেন্ডার না হওয়ার ফলে প্রকৃত মূল্যে ইজারা দিতে না পারায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ভ‚তুরে মামলা এবং হাইকোর্টের রীটের কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ ইজারা দিতে পারছে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী মহল। ফলে শুল্ক আদায় বাড়লেও সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে পূর্বের নির্ধারিত অর্থই। এ কারনে প্রতিবছর এই খাত থেকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে বিরাট অংকের অর্থ। সেইসাথে প্রকৃত মূল্য দিয়ে বন্দর ইজারা নিতে ইচ্ছুক একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও মামলার স্থগিতাদেশের কারণে তেমন কিছুই করার নেই বলে দাবী করছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। এদিকে ইজারা বন্ধ থাকলেও চড়া শুল্ক আদায় করছে জনতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড। মামলা দিয়ে ৭ বছর ইজারা বন্ধ রেখে জনতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি কৌশলে বাঘাবাড়ি নৌ বন্দর নিজেদের করায়ত্বে রেখেছে প্রায় এক যুগ ধরে। নির্দিষ্ট একটি পক্ষকে দীর্ঘকাল সুবিধা দিতে কারো যোগসাজশ আছে কিনা সে নিয়েও জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন, আলোচনা ও সমালোচনা।

উত্তরবঙ্গের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এই বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দর থেকে সরকার প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে। বিআইডাবিøউটি’র বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দরটি উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। সরকার প্রতি বছর এই বন্দরের ইজারা খাত থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা অর্থ রাজস্ব পায়।
এছাড়া বাঘাবাড়ী বন্দরের পাশে রয়েছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তেল ডিপো। সরকারি সার, তেল, ধান, চাল, কয়লা, পাথর, সিমেন্ট, ক্লিংকারসহ বেসরকারি বিভিন্ন মালামাল এই বন্দর থেকে লোড- আনলোড করে উত্তরবঙ্গের ১৬ টি জেলায় সর্বরাহ করা হয়। এছাড়াও বাঘাবাড়ীতেই রয়েছে সরকারি বাফার গুদাম। সরকার এসব থেকে প্রচুর পরিমান রাজস্ব পায় এবং এই বন্দরের উপর নির্ভর করে প্রায় দুই হাজার শ্রমিকের ভাগ্য।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ নং ৭৫ দ্বারা গঠিত এবং সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন নং ৪৬৩ এইচটিডি এর মাধ্যমে ১৯৬০ সাল থেকে বন্দর সমূহের সংরক্ষণে নিযুক্ত বাংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত শর্তাবলীর মাধ্যমে ইজারা প্রদান করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বন্দর কর্তৃপক্ষ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বাঘাবাড়ি নৌ বন্দর ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে জনতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা প্রদান করেন। এরপর বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আরও দুইবার ইজারা পায় প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে সর্বমোট ১ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিনিময়ে ইজারা গ্রহণ করে জনতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড। এই সময়ের মধ্যে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, অবরোধ, নদীর পাড় শুকিয়ে যাওয়া, নদীর দক্ষিণ পাড়ে নৌ ফায়ার সার্ভিসের বিল্ডিং নির্মানসহ দফায় দফায় বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মোট ৬১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবী করে জনতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড। এদিকে এসমস্ত কারণকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন উল্লেখ করে সকল আবেদন নাকচ করে দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে জনতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুছ ছালাম বাদী হয়ে শাহজাদপুর উপজেলা যুগ্ম জেলা জজ চৌকি আদালতে (১১৯/২০১৭ নং) মামলা দায়ের করেন। সেই মামলাকেও ভিত্তিহীন, কাল্পনিক দাবী করে আদালতে ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর লিখিতভাবে জবাব দেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের পক্ষে বাঘাবাড়ি বন্দরের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক এস এম সাজ্জাদুর রহমান। তিনি জবাবে উল্লেখ করেন, ইজারার চুক্তিতে ১৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্পষ্ট উল্লেখ আছে কোন নৈসর্গিক কারনে বা হরতাল/ অবরোধ/ ধর্মঘটের কারনে বা ক্ষমতা বহির্ভূত কোন কারনে যদি খালে নৌ চলাচল বা ঘাট পয়েন্টে যাত্রী ও পণ্য উঠানোর কাজ বন্ধ থাকে সে ক্ষেত্রে ইজারা গ্রহিতাকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ কিংবা ইজারার অর্থ ফেরত দিবে না কর্তৃপক্ষ। এই সমস্ত শর্ত জানার পরও রহস্যজনক কারণে বাদীর পক্ষে মামলা চালিয়ে বছরের পর বছর ইজারা বন্ধ রেখে সরকারকে প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে অবৈধ পন্থায় শুল্ক আদায় করে আসছে জনতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি।
বিষয়টি নিয়ে আমার সংবাদের সাথে কথা হয় সাবেক পোর্ট ইজারাদার আলতাফ সরকারের সাথে। তিনি জানান, এটি সম্পূর্ণ ভূয়া মামলা। কিছু মানুষকে বিরাট অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে মামলার নামে তামাশা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে একটি চক্র। মূলত পোর্টের ইজারা বন্ধ রাখতে কৌশলে যে মামলা করেছে তা কোন যুক্তিতেই টিকতে পারে না। এখানে যে কারণ দেখানো হয়েছে সেগুলো অতি তুচ্ছ এবং হাস্যকর। কারন প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে নদীর পাড় শুকিয়ে যায়। এর কারনে শুল্ক আদায় তো বন্ধ থাকেনা কখনো।
আরেকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আবুল সরকার আমার সংবাদকে জানান, মামলায় হরতাল অবরোধের কারনে ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। এটা চরম চতুরতা। কারন হরতাল, অবরোধে সড়কপথে যান চলাচল বন্ধ থাকালেও নৌযান চলাচল বন্ধ থাকেনি। সেক্ষেত্রে বন্দরে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ফলে ক্ষতির কথা বলা হলেও ব্যাপক লাভবান হয় প্রতিষ্ঠানটি। মূলত প্রচুর মুনাফা করার পরও কেবল সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে নিজেদের করায়ত্বে বন্দর কুক্ষিগত করে রেখে লোকসান দেখিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটি মামলা দিয়ে এবং হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ করিয়ে বছরের পর বছর ইজারা বন্ধ রেখেছে ছালাম বেপারির সমিতি।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাঘাবাড়ি বন্দরের বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক এস এম সাজ্জাদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে আমার সংবাদকে জানান, তিনি আর বাঘাবাড়ি পোর্টে কর্মরত নেই বলে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে পারবেন না।
বিষয়টি নিয়ে বাঘাবাড়িতে কর্মরত বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মামলাটি যেহেতু আদালতে চলমান রয়েছে তাই এ সম্পর্কে মন্তব্য করা উচিৎ হবে না।’

 

 

আপনি আরও পড়তে পারেন