রূপগঞ্জের বিল জুড়ে এখন হলুদের সমারোহ

রূপগঞ্জের বিল জুড়ে এখন হলুদের সমারোহ

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ রূপগঞ্জের মাঠে মাঠে এখন হলুদের সমারোহ। বাতাসে হলুদের মৌ মৌ ঘ্রাণ। হলদে ফুলে চুমু খাচ্ছে মৌমাছি। ভ্রমন পিপাসুরা ভীড় জমাচ্ছেন সরিষার হলুদে মাঠে। সেলফী তুলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কৃষক বলেন, এ সেলফীবাজদের যন্ত্রণায় সরিষা ক্ষেতের অনেক ক্ষতি হয়। তারপরও ভাল লাগে এই ভেবে আমার সরিষা ক্ষেতের ছবিটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন কৃষক বলেন, এখন আর কি সরিষার চাষ হয়। সবতো বালি দিয়ে ভরাট করে ফেলছে ভ’মিদস্যুরা। ফসলের মাঠ , খাল বিল সব হারিয়ে যাচ্ছে। রূপগঞ্জের চারিদিকে এখন ধু ধু বালিচর। কৃষকের স্বপ্ন এখন বালির নীচে চাপা পড়ে আছে।
ফসলের মাঠে সরিষা ফুলের হলুদের সমারোহ। হলুদ রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জন এবং বাতাসে দুলতে থাকা ফুলে দোল খাচ্ছে কৃষকের রঙিন স্বপ্ন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় সরিষা চাষ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। অন্য ফসলের মাঝখানে সাথী ফসল হিসেবে কৃষকরা সরিষা চাষকে বোনাস হিসেবে দেখছে। সরিষা তুলে সে জমিতে আবার বোরো আবাদ করা যায়। এতে কৃষিজমির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। একসময় কৃষকরা আমন ধান কাটার পর জমি পতিত ফেলে রাখত। সময়ের সাথে সাথে তা পুরোটাই পাল্টে গেছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখন সরিষা চাষ খুবই লাভজনক একটা আবাদ। অতি অল্প সময়ে, অল্প পুঁজিতে এ ফসল চাষ করা যায়। এক বিঘা (৩০ শতাংশ) জমিতে সরিষা আবাদ করতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা যায় তাহলে প্রতি বিঘায় ফলন হয় পাঁচ থেকে ছয় মণ সরিষা। উপজেলার পশ্চিমগাও এলাকার চাষি হালিম জানান, দুই বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। প্রতি বিঘা জমিতে দেড় হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে। সরিষার ফুলে ক্ষেত ভরে গেছে। আর কোনো সমস্যা না হলে বিঘাপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় মণ সরিষা পাওয়া যাবে।
বলাইখা এলাকার কৃষক আফসার মিয়া বলেন, আমন ধান কাটার পর দুই বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। আশা করছি বেশ ভালো ফলন হবে। এই সরিষা বিক্রি করে বোরো আবাদের তেল ও সার কেনার টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। গঙ্গানগর গ্রামের কৃষক আলী হোসেন বলেন, ধান আবাদে কোনো লাভ নেই, উৎপাদন খরচই ওঠে না। সরিষা আবাদে এক থেকে দুইবার সেচ দিলে চলে। বাজারদর ভালো হলে এক মণ সরিষা ১৭০০-১৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
বিভিন্ন জাতে বারি ও বীনা সরিষার আবাদ হয়েছে রূপগঞ্জে। সাথী ফসল হিসেবে সরিষা চাষ করে ভালো ফলন ও দাম পেয়ে রূপগঞ্জের কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে।  উপজেলার হাটাব, কেড়ার, মিঠাব, কান্দাপাড়া, মাসাব, তেতলাব, পশ্চিম গাও, মাঝিপাড়া, পাচাইখা, বলাইখাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হলুদে ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো মাঠ। উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ২ হাজার ১৬৫ একর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়েছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। এ যেন কুয়াশায় ঢাকা শীতের চাদরে দিগন্ত জোড়া সরিষার হলুদ মাঠ। মাঠজুড়ে হলুদ ফুলের সমারোহ। সরিষার ফুলে আকৃষ্ট মৌমাছিরাও, ব্যস্ত মধু আহরণে। সরিষা ফুলের হলুদ রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা মাঠ। হলুদের সমারোহে সজ্জিত সরিষার প্রতিটি ফুলে দুলছে কৃষকের রঙিন স্বপ্ন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন ভালো ফলনের জন্য করণীয় বিষয়ে বলেন, সরিষার চাষে বোরন ব্যবহার করলে দানা পুষ্ট হবে ও ফলন বৃদ্ধি পাবে। জাত ভেদে সরিষা আবাদের মাত্র ৮০-১০০ দিনেই ফসল ঘরে তোলা যায়। প্রতি কেজি সরিষা থেকে ৩৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম তেল পাওয়া যেতে পারে। সরিষা চাষের জমিতে বোরো ধানের আবাদ ভালো হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কায়ছুন নাহার হাওলাদার বলেন, এ উপজেলার মাটি সরিষা আবাদের জন্য অনেক উপযোগী। উপজেলায় গত বছরের তুলনায় সরিষা আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরিষা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য বারি সরিষা- ৯, ১১, ১৪, ১৫, ১৭ ও ১৮ জাতের ৩০টি প্রদর্শনী ও ৫০০ কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বীনা ৪ ও ৯ জাতের সরিষাও আবাদ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা চাষের জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করি ও বিভিন্ন উপকরণ সহায়তা দেই। সর্বোপরি এ বছর করোনা ও বন্যায় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিধায় সরকারের নির্দেশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা কৃষি বিভাগের মাধ্যমে দুই হাজার কৃষককে সরিষা চাষে কৃষি প্রণোদনা বিতরণসহ সার্বিক সহযোগিতায় তাদের পাশে আছেন উপজেলা কৃষি বিভাগ। তিনি আরো জানান, এ দিকে এবার বিভিন্ন এলাকা থেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য এক হাজার ২০০ মৌবক্স নিয়ে প্রস্তুত আছে মৌচাষীরাও।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাতেহা নুর বলেন, সরিষা মূলত একটি মসলা জাতীয় ফসল। স্বল্প সময়ের মধ্যে কৃষককে অধিক ফলন পেতে নানাভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, যাতে কৃষকের কোনো সমস্যা না হয়। আশা করছি প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটলে এবার সরিষার বাম্পার ফলন হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন