নওগাঁ পাসপোর্ট অফিসে মাসে কোটি টাকার রমরমা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ!

নওগাঁ পাসপোর্ট অফিসে মাসে কোটি টাকার রমরমা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ!

নওগাঁয় দালাল ছাড়া পাসপোর্ট জমা নিতে গড়িমসি; চ্যানেল ফাইলে রমরমা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ!

নওগাঁ প্রতিনিধি: নওগাঁ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে অফিসে কর্মরত কর্মচারী-আনসার সদস্যসহ বড় কর্তার প্রতি মাসে অবৈধ আয় প্রায় কোটি টাকা। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে নওগাঁ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নওগাঁ আঞ্চলিক পাসপোর্টের অফিসে প্রতিদিন গড়ে এক শত আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে বেশির ভাগ আবেদন জমা হয় ‘ঘুষ চ্যানেলে’। আবেদনপ্রতি ন্যূনতম ঘুষ নেওয়া হয় ৩ হাজার টাকা। এ হিসাবে দৈনিক ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩ লাখ টাকা। মাসে আসে ৯০লক্ষ বা প্রায় ১কোটি টাকা।

এসব ঘুষ লেনদেনের বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে। এসব ফুটেজে দেখা যায়, গত ৪ জানুয়ারী মান্দা উপজেলা থেকে আসা এক ব্যক্তির কাছে ১ হাজার ৪’শ টাকা ঘুষ নিয়েছেন নওগাঁ পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্য ওমর ফারুখ। ৬ জানুয়ারী আরেক আনসার সদস্য মিন্টু এক ব্যক্তির ৫ বছর মেয়াদী দুটি পাসপোর্ট করে দেয়ার বিনিময়ে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসহ দাবী করেন ১৫ হাজার টাকা। ঠিক এভাবেই প্রতিনিয়তই ঘুষ বানিজ্য চলছে নওগাঁ পাসপোর্ট অফিসে। তবে আনসারদের দাবী এসব টাকার ভাগ দিতে হয় উপর মহলে।

এ অফিসের বাহিরের চিত্র আরও ভয়াবহ। আশপাশের কিছু অনলাইন ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি বসে থাকে ফাঁদ পেতে। অসহায় মানুষদের পকেট কাটেন ইচ্ছেমত।

পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারী’২০২১ থেকে ৩০ ডিসেম্বর’২০২১ পর্যন্ত সময়ে এই এক বছরে জেলার ১৬ হাজার ৬শ ৩০টি মানুষ তাঁদের পাসপোর্ট সম্পাদন করেছেন। এসব পাসপোর্টের সবগুলোই ছিল ই-পাসপোর্ট। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে ২২১৬টি, অক্টোবরে ২২৮৪টি, নভেম্বরে ২২৩০টি এবং ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ৩৩৩২টি পাসপোর্ট সম্পাদন করা হয়েছে।

পাসপোর্ট অফিসে আসা প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ৪৮ পাতা বিশিষ্ট ৫ থেকে ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট করে থাকেন। ৫ বছর মেয়াদী ৪৮ পাতার একটি সাধারন ই-পাসপোর্টে সরকারী ফি বাবদ ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হয় ৪,০২৫ টাকা, জরুরী হলে ৬,৩২৫ টাকা এবং ১০ বছর মেয়াদী ৪৮ পাতার একটি সাধারন ই-পাসপোর্টের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হয় ৫,৭৫০ টাকা এবং জরুরী হলে ৮,০৫০ টাকা।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, একটি পাসপোর্টের জন্য একজন গ্রাহককে সরকার নিধার্রিত ফি ছাড়াও দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। ৫ বছর মেয়াদী ৪৮ পাতার একটি সাধারন ই-পাসপোর্টে ঘুষসহ তাকে দিতে হবে ৭ থেকে ৮ হাজার, জরুরী হলে দিতে হবে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা এবং ১০ বছর মেয়াদী ৪৮ পাতার একটি সাধারন ই-পাসপোর্টের জন্য সাড়ে ৮ থেকে ৯ হাজার ও জরুরী হলে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা।

তাদের দুর্নীতির কৌশলের কারণে পাসপোর্টের আবেদনকারীদের ভোগান্তির শেষ নেই। সপ্তাহে ঘুরে মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। জরুরি পাসপোর্ট পেতেও অপেক্ষা করতে হয় কয়েক সপ্তাহ।

পাসপোর্টের জন্য যারা সরাসরি আবেদন জমা দেন সেগুলোকে পাসপোর্ট অফিসে বলা হয় পাবলিক ফাইল। আর যারা কারও মাধ্যমে আবেদন জমা দেন সেগুলোকে বলা হয় চ্যানেলের ফাইল। সরাসরি জমাদানকারীদের আবেদনপত্র নিয়ে চক্রগুলো অবাধে নগদ বাণিজ্য করছে।

জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতি দিন শত শত আবেদনকারীরা পাসপোর্ট করতে এসে পড়ে যান গোলক ধাঁধার মধ্যে। অফিসের বাইরে ওঁত পেতে থাকা প্রতারক ও দালাল চক্রের খপ্পর এড়াতে অফিসের যে কারও কাছে পাসপোর্ট করার তথ্য জানতে গেলে সেও পরামর্শ দেয় নির্ধারিত ‘চ্যানেল ফি’ দিয়ে পাসপোর্ট করার। চ্যানেল ফি ছাড়া গ্রাহক নিজ উদ্যোগে লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার চেষ্টা করলে তার আবেদনে নানাবিধ সমস্যা আর ভুল দেখিয়ে দিনের পর দিন ফেরৎ দেয়া হয়।

তবে নির্ধারিত চ্যানেলের টাকাসহ আবেদনপত্র জমাদিলে তা সঙ্গে সঙ্গে জমা নিয়ে আঙ্গুলের ছাপ ও ছবি করে দেয়া হয় মূহুর্তে। এভাবেই প্রত্যেক গ্রাহককে ভোগান্তি এড়াতে নির্ধারিত ব্যাংক ফি বাদে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট করতে হয়।

ভুক্তভোগীরা জানান, দূর-দূরান্ত থেকে পাসপোর্ট করতে আসা শত শত সাধারণ মানুষ আবেদনপত্র নিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর বিভিন্ন ওযুহাতে অধিকাংশ আবেদনপত্র ফেরত দেয়া হয়। আর এ কাজটি করে পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম, রবিউল ইসলাম, মোক্তারসহ কয়েকজন কর্মচারী।

মহাদেবপুর সদর এলাকা থেকে থ্রিস্টার ডায়াগনস্টিকের মালিক সাজ্জাদ হোসেন ওমরা হজের জন্য পাসপোর্ট করতে এসেছেন। কিন্তু তার কাছেও দালালরা ঘুষ দাবি করায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, প্রশাসন এসব কিছুই দেখছে না। সংশ্লিষ্ট উর্ধতন প্রশাসনকে মাসিক মাসহারা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে অবৈধ আয় যেন ওপেন সিক্রেট।

মান্দা উপজেলার আলম বলেন, আমার কাগজপত্রে দালালদের সাংকেতিক চিহ্ন না থাকায় আমাকে কয়েকবার ঘুরিয়েছে। ঘুষ নেওয়ার জন্য পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা এভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে টাল-বাহানা করে।

এ ব্যাপারে নওগাঁ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারি পরিচালক শওকত কামালের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে এসব অভিযোগ অস্বিকার করেন। অভিযোগের তথ্য প্রমান উপস্থাপনের চেষ্টা করলে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি কল কেটে দেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন