হোসেনপুরে মৌমাছির বিচরণ তুলনামূলক কম

হোসেনপুরে মৌমাছির বিচরণ তুলনামূলক কম
মাহফুজ রাজা, জেলা প্রতিনিধি,  কিশোরগঞ্জ ;
“মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি,
দাঁড়াও না একবার ভাই।
ঔ ফুল ফুটে বনে যাই মধু আহরণে,
দাঁড়াইবার সময়তু নাই”
কবির কাব্য শৈল্পিকনায় স্পষ্ট  ফুটে উঠেছে মৌমাছির কর্মপ্রিয়তা,মৌমাছি বা মধুমক্ষিকা বা মধুকর । বোলতা এবং পিঁপড়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গবিশেষ।
মৌমাছি শরিষার হলুদ গালিজার বুকে বিকশিত উচ্চ শির করা বুকটান হলুদ মিশ্রিত ফুলের মায়াবী আস্তরণে যখন বিচরণ করে গুনগুন গানের রমরমা গুঞ্জনের সাথে,
সত্যিকার অর্থেই যেনো প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ফুটে,
মহানন্দ লুটিয়ে পড়ে ধরাতলে।
মৌমাছি নামক ছোট এ প্রানিটা কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বিলিনের শেষাংশে,উপজেলার প্রায় সবকটি গ্রামেই ঘরের কোনায়,জঙ্গলের কোনো উচ্চ গাছের চূড়ায় চাক বেঁধে অবস্থান করে,দেখা যাই শরিষার ফুলের বুকে বিচরণ করতে তা থেকে মধু আহরণ করতে,আর মৌ মৌ শব্দে চতুষ্পার্শ্ব মাতিয়ে রাখতে।
চরের মাঠে ময়দানে বিশেষ করে চর জামাইল,সাহেবের চর,বিশ্বনাথপুর,চরকাটিহারী, চরহাজীপুর, ইত্যাদি গ্রামগুলিতে এখন তেমন নেই মৌমাছির সরগরম অবস্থা। কেউ আর পালাইনা লাল জামা পড়ে মৌমাছির তাড়া খেয়ে ,হাছেন(শকুন) আর থাবা দেইনা মৌচাকে,মধু শিকারীদের ছুটাছুটি নেই তেমন হোসেনপুরে।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়,মৌমাছি অর্থবহ একটা পাখি,মধু ও মোম উৎপাদন এবং ফুলের পরাগায়ণের জন্য প্রসিদ্ধ।পৃথিবীতে ৯টি স্বীকৃত গোত্রের অধীনে প্রায় কুড়ি হাজার মৌমাছি প্রজাতি আছে, যদিও এর বেশিরভাগেরই কোন বর্ণনা নেই এবং এর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।
মৌমাছির দেহ ত্রিখণ্ডিত,এদের দুই জোড়া ডানা রয়েছে। এদের দেহের মাপ ১-১.৫ সেন্টিমিটার(প্রায় ½ ইঞ্চি থেকে ¾ ইঞ্চি)
প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা বসতিবদ্ধ হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে ৷ আকার ও কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিরা তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত:
১৷ রানি মৌমাছি যা একমাত্র উর্বর মৌমাছি
২৷ ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি
৩৷ কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছি
মৌমাছি মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। যাকে আরবিতে বলা হয় ‘নাহল’। পবিত্র কোরআনে ‘নাহল’ নামে একটি সুরাই অবতীর্ণ হয়েছে।
মৌমাছি আমাদের জন্য উৎকৃষ্ট মধু আহরণ করে। প্রিয় নবী (সা.) মধু খেতে খুব ভালোবাসতেন। (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস: ১২১)।
জানা যায়, এরা খুবই পরিশ্রমী পতঙ্গ। ফুলের রস মুখে নিয়ে, সেটা থেকে জলীয় অংশ দূর করে শতভাগ ভেজালমুক্ত এক ফোঁটা মধু তৈরি করতে যে শ্রম ও সময় ব্যয় করে সেটা বিস্ময়কর! এক পাউন্ড মধু বানাতে ৫৫০ মৌমাছিকে প্রায় ২০ লাখ ফুলে ভ্রমণ করতে হয়! আবার এক পাউন্ড মধু সংগ্রহ করতে একটি কর্মী মৌমাছিকে প্রায় ১৪.৫ লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়! যা দিয়ে পৃথিবীকে তিনবার প্রদক্ষিণ করা সম্ভব
মৌমাছির চাকের গঠন ষড়ুভুজাকার হওয়ায় গবেষকেরা ভাবতেন, মৌমাছি বুঝি জ্যামিতি জানে৷ বিস্ময়কর ভাবে গবেষণা করে দেখা গেছে মৌমাছিরা যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে পারে৷
বিশেষ পর্যালোচনায় প্রকাশ পায়,এমন ক্ষুদ্র প্রাণীটির সঙ্গে মানুষের মধুর সম্পর্ক প্রায় আট হাজার বছর অর্থাৎ সেই নব্যপ্রস্তরযুগ থেকে। তখন থেকেই মানুষ মধু এবং মোমের জন্য এই প্রাণীটির ওপর নির্ভর করত। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে যখন আজকের মতো চিনি সহজলভ্য ছিল না, সেই কালে খাবারদাবার মিষ্টি করতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই মধুর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। মৌমাছি প্রাণী হিসেবে ক্ষুদ্র হলেও এর ওপর নির্ভর করছে মানুষের টিকে থাকা বা না–থাকা।
 জৈনেক অণুজীববিজ্ঞানীর মতানুসারে, মৌমাছি
একবার নেকটার (মৌ-রস) এবং পরাগরেণু সংগ্রহে বের হলে একটি মৌমাছি প্রতি সেকেন্ডে ২০০ বার পাখা ঝাঁপটিয়ে ঘুরে আসে ৫০ থেকে ১০০০ ফুল। এক কেজি মধু উৎপাদনে কম করে হলেও ছয় হাজার মৌমাছির বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া প্রায় দুই সপ্তাহ ৬০ লাখ ফুল থেকে মৌ-রস সংগ্রহ করতে হয়। এ জন্য তাকে চষে বেড়াতে হয় ১ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার (৯৩ হাজার মাইল), প্রায় ৪ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণের সমান পথ।
একটি মৌচাকে ৭০ হাজার মৌমাছি বছরে গড়ে ৩০ কেজি মধু উৎপাদন করে। একটি মৌমাছি জীবনকালে এক চা–চামচের ১২ ভাগের ১ ভাগ মধু উৎপাদন করতে পারে। অর্থাৎ এক চা–চামচ মধুর জন্য ১২টি মৌমাছির সারা জীবন চলে যায়।
বসন্তে যখন গাছে গাছে ফুলের সমারোহ দেখা যায়, মৌমাছি সে সময়টুকুতে প্রচুর পরিশ্রম করে ফুলের মৌ-রস এবং পরাগরেণু সংগ্রহ করতে গিয়ে পরাগায়ন ঘটায় বিশাল সংখ্যক উদ্ভিদে। যার ফলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে প্রচুর উদ্ভিদ। আর উদ্ভিদের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন। ফলে উদ্ভিদের সুরক্ষায় রক্ষা পাচ্ছে মানুষের এবং আরও অনেক প্রাণীর জীবন। আর এই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মৌমাছি এমন কাজ করে চলছে প্রায় ১৫ কোটি বছর ধরে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, মৌমাছি ছাড়া মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই মৌমাছির মধু নয়, তার দিকেই আমাদেরকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, বিশ্ব মানবতার প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে এই ছোট্ট সুন্দর ফুলপ্রেমী প্রাণীটির মধ্যে।
মৌমাছির গুরুত্ব বুঝাতে পবিত্র কোরআনে  উল্লেখ আছে,
“পাহাড় – পর্বতের গায়ে,গাছে এবং উঁচু চালে ঘর তৈরি কর।এরপর সকল প্রকার ফল থেকে খাও এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথ সমূহে চল।”সূরা আন নহল-৬৮-৬৯”
১৯৭৩ সালে, ‘Von Frisch’মৌমাছির আচরণ ও যোগযোগের উপর গবেষণার জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।‘মৌমাছি কোন নতুন ফুলের বাগানের সন্ধান পেলে মৌচাকে ফিরে আসে এবং মৌমাছির নাচ’নামক আচরণ দ্বারা অন্যান্য সাথীদেরকে সে বাগানের হুবুহু দিক ও মানচিত্র বলে দেয়।অন্যান্য শ্রমিক মৌমাছিকে তথ্য দেয়ার লক্ষ্যে এ আচরণের বিষয়টি ক্যামেরার সাহায্যে ছবি গ্রহণ সহ অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকভাবে আবিষ্কৃত সত্য।
 শেক্সপিয়ারের ‘Henry the fourth’নাটকের কিছু চরিত্রে মৌমাছি সম্পর্কে আলোচনা এসেছে।সেখানে মৌমাছিকে সৈনিক উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তাদের একজন রাজা আছে।শেক্সপিয়ারের যুগে মানুষে এরকমই চিন্তা করত।তাদের ধারণা যে,শ্রমিক মৌমাছিরা পুরুষ।তারা ঘরে ফিরে রাজা মৌমাছির কাছে জবাবদিহী করে।যাই হোক এটা সত্য নয়।শ্রমিক মৌমাছিরা স্ত্রী জাতীয় এবং তারা রাজার কাছে নয়,বরং বাণীর কাছে জবাবদিহী করে।আজ থেকে ৩শ বছর আগে আধুনিক গবেষণায় তা আবিষ্কৃত হয়েছে।অথচ,কোরআন তা ১৪শ বছর আগে বলেছে।
কেউ যদি বিশেষ কোন গাছের ফলের এলার্জি রোগে ভোগে,তাহলে তাকে ঐ গাছ থেকে আহরিত মধু পান করালে,তার এলার্জি প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।মধু ফলের চিনি এবং ভিটামিন কে দ্বারা সমৃদ্ধ।মধু,এর উৎস ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত জ্ঞান,কোরআন নাযিলের পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরাও আবিষ্কার করেছেন।
প্রকৃতগত ভাবে মৌমাছির অবধান উল্লেখযোগ্য,
হোসেনপুর উপজেলার অসংখ্য ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়,হেসেনপুরে বানিজ্যিক ভাবে নেই মৌমাছির চাষ,সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মৌমাছির রক্ষনাভক্ষন মধু আহরণের ব্যবস্থা হলে ভালো হতো।

আপনি আরও পড়তে পারেন