নিষেধাজ্ঞায় আমরা কী শুধু চাল খাইয়া থাকমু

নিষেধাজ্ঞায় আমরা কী শুধু চাল খাইয়া থাকমু

দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভোলার মেঘনা-তেতুলিয়ার ১৯০ কিলোমিটার এলাকার অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ, পরিবহন, বিক্রি ও মজুতের মচ্ছব চলছে। প্রশাসন নিয়মিত দায়সারা অভিযান চালালেও তাদের ম্যানেজ করেই মাছ শিকার ও বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভোলার ইলিশা ফেরিঘাট ও নৌ থানার পাশেই রয়েছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি মাছঘাট। সেখানে নদী থেকে জেলেরা তাদের নৌকা ও ট্রলারযোগে মাছ শিকার করে তীরে ফিরছে। আর প্রকাশ্যে হাকডাকের মাধ্যমেই তা বিক্রি হচ্ছে। ভোর না হতেই শুরু হয় বেচাকেনা। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে ঘাট থেকে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ কিনে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করছেন।

কথা হয় এক জেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকার অভিযান দিছে। আর অভিযানের সময় নদীতে ইলিশ ও পোয়া মাছ বেশি ধরা পড়ে। তাই আমরা অভিযানে মাছ ধরছি। জালে ছোট বড় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। দামও মোটামুটি ভালো।

এছাড়া সদর উপজেলা, ইলিশা বাজার, পরানগঞ্জ বাজার, কাঁচাবাজার, সদর রোড, বাসস্ট্যান্ড, ঘুইংগার হাট, বাংলা বাজারসহ ছোট-বড় সব বাজারেই প্রকাশ্যে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ দেখেও যেন না দেখার ভান করছেন।

ইলিশা মাছঘাটে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে জানান, কেন মাছ ধরব না? নদীতে কেন যামু না? সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কিন্তু আমাদের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করেনি। আমাদেরও তো সংসার আছে। প্রতিদিন আমাদের চাল-ডাল কিনে পরিবারের মুখে খাবার যোগাতে হয়। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অপরদিকে নদীতে মাছ ধরা নিষেধ। কোথায় যাব আমরা? অভিযানের এত দিন পার হলেও সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি।

জেলেরা বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মাছ শিকার ছাড়া আমাদের বিকল্প কোনো পথ নেই। অভিযানের সময় আমাদের বেকার ঘরে বসে থাকতে হয়। কিন্তু সপ্তাহ শেষ না হতেই এনজিও কর্মীরা এসে ঘরের দরজার কড়া নাড়ে।সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে শুনতে হয় অনেক কথা। ঘরের বউ-ঝির সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।

জানা গেছে, জেলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩ লাখ জেলে থাকলেও সরকার নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার। তাদের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে চাল বরাদ্দ হয়েছে ৯২ হাজার ৬৬১ জন জেলের। তবে নিষেধাজ্ঞার ১১ দিন পার হতে চললেও জেলেদের ভাগ্যে জোটেনি চালসহ অন্য কোনো সহযোগিতা। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলেরা। অভাব-অনাটন আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে তাদের।

ইলিশসহ সব ধরনের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশা থেকে চর পিয়ালের শাহবাজপুর চ্যানেলে মেঘনা নদীর ৯০ কিলোমিটার এবং ভেদুরিয়া থেকে চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে কিছু অসাধু জেলে নদীতে মাছ শিকার করলেও যেতে পারছেন না বাকি জেলেরা। জাল-নৌকা তুলে ঘাটে নিয়ে রেখেছেন অনেকেই। কেউ আবার বিকল্প পেশা খুঁজছেন।

ভোলা সদরের তুলাতলী এলাকার জেলে বশির বলেন, আমরা সরকারের নির্দেশ মেনে নদীতে মাছ ধরা থেকে বিরত রয়েছি। কিন্তু জেলেদের জন্য বরাদ্দ করা চাল এখনো আমরা পাইনি। আমার ট্রলারে ২২ জন জেলে রয়েছে। তারা সবাই ঋণের দায়ে জর্জরিত। সবাই খুব কষ্টে আছেন।

শিবপুরের ছালেম মাঝি বলেন, আমরা নদীর কাজ ছাড়া অন্য কাজ জানি না। তাই মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে গেছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আর সরকার দুই মাসের অভিযানে যে চাল দেয় তা তো আমাগো ২০ দিনেও হয় না। আর আমরা কী শুধু চাল খাইয়া থাকমু।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন জানান, ভোলা জেলের জন্য ৯২ হাজার ৬৬১ জনের প্রথম দুই কিস্তির (ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) প্রায় ৭ হাজার ৫শ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে গত সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় বিতরণ শুরু হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম আজহারুল ইসলাম জানান, ভোলায় প্রায় ৩ লাখ জেলে রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা নদীতে মাছ শিকারে যায় তা অতি সামান্য। কিছু অসাধু জেলে রাতের আঁধারে নদীতে মাছ ধরছে। তাদের বিরুদ্ধে  নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। আমরা প্রথম দিক থেকেই কঠোর অবস্থানে আছি।

জেলেদের চাল বিতরণে দেরি হচ্ছে কেন এমন প্রশ্নে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এটি চলমান প্রক্রিয়া। ইউনিয়ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তালিকা প্রণয়ন করে সহায়তা দেওয়া হয়। শিগগিরই জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হবে। চাল বিতরণে কোনো অবহেলা নেই বলেও মনে করেন তিনি।

আপনি আরও পড়তে পারেন