সন্তান বিক্রি করায় স্বামীকে তালাক, স্ত্রীর গায়ে আগুন

সন্তান বিক্রি করায় স্বামীকে তালাক, স্ত্রীর গায়ে আগুন

কখনো নেশার টাকার জন্য মারধর, কখনো বা শ্বশুরবাড়ির লোকদের বঞ্চনা। এত কিছুর পরও স্বামী-সংসার ছাড়তে চাননি নূপুর (২৪)। কিন্তু ৪ মাসের শিশু সন্তানকে স্বামী নাজমুল মিঞা (৩২) বিক্রি করে দিলে তা আর মেনে নিতে পারেননি তিনি। সন্তান হারানোর বেদনা, কষ্ট আর ক্ষোভ তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। তালাক দেন মাদকাসক্ত স্বামী নাজমুলকে।

তবে তালাক দেওয়ার বিষয়টি সহজভাবে নেননি নাজমুল। মাথায় ঘুরতে থাকে প্রতিশোধের নেশা। সুযোগ বুঝে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর নূপুরের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন নাজমুল। এ ঘটনায় মারাত্মক দগ্ধ হন তিনি। শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ পুড়ে যায় তার। পরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দীর্ঘ ৪৫ দিনের চিকিৎসা শেষে বাবার বাড়ি ফিরে আসেন নূপুর।

নূপুর শেরপুরের নকলা উপজেলার গণপদ্দী ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা তোতা মিয়া পেশায় একজন দিনমজুর।

নূপুরের বাবা তোতা মিয়া বলেন, সংসারে আমরা ৩ জন। আমাদের একমাত্র মেয়ে নূপুর। আমার স্ত্রী ফুলমালা শারীরিক প্রতিবন্ধী। মেধাবী হওয়ার পরও অভাবের কারণে ৮ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নকলা উপজেলা সদরের দরবেশ আলীর ছেলে নাজমুলের সঙ্গে নূপুরের বিয়ে দেই। বিয়ের পর জানতে পারি নাজমুল মাদকাসক্ত। সে নেশার টাকার জন্য মেয়েকে মারধর করে। এভাবে চলতে থাকে কয়েকবছর। এরই মধ্যে মেয়ের সংসারে আসে ফুটফুটে নাতি। তাকে ৪ মাস বয়সে নেশার টাকার জন্য বিক্রি করে দেয় নাজমুল। সন্তান বিক্রি করে দেওয়ায় রাগে-ক্ষোভে নাজমুলকে তালাক দেয় আমার মেয়ে। পরে জীবন-জীবিকার তাগিদে গাজিপুরের জয়দেবপুর এলাকায় একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেয় নূপুর।

তালাক দেওয়ায় আমার মেয়ের ওপর ক্ষোভ ছিল নাজমুলের জানিয়ে তোতা মিয়া আরও বলেন, নূপুরের খোঁজে জয়দেবপুর চলে আসে নাজমুল। এক পর্যায়ে সে আমার মেয়ের খোঁজ পেয়ে যায়। নূপুরকে সে অনুসরণ করতে থাকে। পরে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফেরার পথে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা নাজমুল আমার মেয়ের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয় নূপুর।

পরে সঙ্গে থাকা পোশাককর্মীরা নূপুরের গায়ে ধরা আগুর নিয়ন্ত্রণে আনে। সেখান থেকে গুরুতর আহত নূপুরকে নেওয়া হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। চিকিৎসা শেষে দীর্ঘ ৪৫ দিন পর নূপুরকে হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসি।

স্থানীয় এলাকাবাসী আকলিমা জানান, বাবার বাড়ি বেড়াতে আসলে নূপুর আর যেতে চাইতো না। আমরা তাকে জোর করে পাঠাতাম। নেশার টাকার জন্য নূপুরকে খুব মারধর করত তার স্বামী। তার শাশুড়িও নূপুরকে ঠিক মতো খেতে দিত না। যদিও দিত সেটা বাসি-পচা খাবার। আমরা বুঝতে পারিনি যে নূপুরকে এমন সময় পার করতে হবে। এলাকাবাসী হিসেবে একটাই দাবি, আমরা নাজমুলের ফাঁসি চাই।

আরেক এলাকাবাসী ফিরোজ মিয়া বলেন, মানুষ এত পাষণ্ড হতে পারে জানা ছিল না। কীভাবে সুস্থ একটি মানুষ অন্যজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে? নূপুরের উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। তার বাবা দরিদ্র দিনমজুর। উনার পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব না। সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে নূপুরের শরীর থেকে পুঁজ ও গন্ধ বের হচ্ছে। অসহায় নুপুর অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার কান্নায় আকাশ-বাতাস যেন ভারি হয়ে আসছে।

ভুক্তভোগী নূপুর জানান, অনেক স্বপ্ন ছিল, স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে দিন কাটাব। কিন্তু সেই স্বপ্ন আমার দুঃস্বপ্নে রূপ নিল। অনেক যন্ত্রণা-বঞ্চনা সহ্য করেও নাজমুলের সংসার করছিলাম। যখন আমার নাড়ি ছেঁড়া ধনকেও নেশার টাকার জন্য বিক্রি করে দিল, তখন আর ঠিক থাকতে পারিনি। তালাক দেওয়ায় নাজমুল পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে আমার পুরো শরীর ঝলসে দিয়েছে। আমি গত ২ মাস থেকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি। কাপড় পরতে পারি না। সব সময় গা জ্বালা-পোড়া করে। আমি চাই, নাজমুলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক।

নকলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, নূপুরের মামলাটি গাজীপুরে রয়েছে। মামলাটি শেরপুর আদালতে স্থানান্তরিত হলে আমাদের জন্য আসামি গ্রেপ্তারে সু্বিধা হবে। নাজমুলের বাড়ি যেহেতু শেরপুর জেলার নকলা উপজেলায়। সেক্ষেত্রে নাজমুলকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে গাজীপুর থানা পুলিশকে আমরা সহযোগিতা করব।

এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. অনুমপ ভট্রাচার্য বলেন, নূপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হলে তার যাবতীয় দেখভাল আমরা করব। যদি সে উন্নত চিকিৎসার জন্য বড় কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে চায়, তাহলে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নূপুরের পাশে থাকবে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ  জানান, ইতোমধ্যে নূপুরের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। আগামীতে নূপুরের যেকোনো প্রয়োজনে শেরপুর জেলা প্রশাসন তার পাশে থাকবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন