শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালাকে যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালাকে যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে।

জসীম উদ্দীনি ইতি ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ
দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে
মো. তোফাজ্জুর রহমান যোগ দেন ২০১২ সালের ৫ মার্চ। পরে ২০১৮ সালের ১০
সেপ্টেম্বর সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদোন্নতি পেয়ে হন অধ্যাপক। একই বছরের ১৩
সেপ্টেম্বর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে যোগ দেন মাউশি
অধিদপ্তরে। এরপর পদোন্নতি প্রজ্ঞাপনের শর্তানুযায়ী ওই বছরের ১৭
সেপ্টেম্বর থেকে একই শিক্ষা বোর্ডে ইনসিটু হিসেবে (পূর্বপদে) কর্মরত
রয়েছেন। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে একই পদে রয়েছে
তিনি। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষকের একই পদে
একটানা তিন বছরের বেশি সময় ধরে থাকার সুযোগ নেই। আর শুধু অধ্যাপক
তোফাজ্জুর রহমানই নন, এই শিক্ষা বোর্ডে তিন বছরের বেশি থেকে এক যুগ ধরে
একই পদে কর্মরত রয়েছেন ছয়জন শিক্ষক ও একজন বিসিএস (শিক্ষা ক্যাডার)
কর্মকর্তা।
চলতি বছর ১৪ আগস্ট দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর একটি
প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সেই প্রতিবেদন থেকে সাত কর্মকর্তার তিন বছরের বেশি
সময় ধরে একই পদে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা
বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত সরকারি কলেজের শিক্ষক
বদলি/পদায়ন নীতিমালা-২০২০’ প্রকাশিত হয়। ওই নীতিমালার ১০ ধারায় বলা
হয়েছে, কোনো কর্মকর্তা দপ্তর/অধিদপ্তর/সংস্থায় একাধিকক্রমে ০৩ (তিন)
বছরের বেশি কর্মরত থাকতে পারবেন না। তবে প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তার
ক্ষেত্রে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল পর্যন্ত বিবেচ্য হবে। এ ছাড়াও ১১ ধারায়
বলা হয়েছে, কোনো কর্মকর্তাকে একটি দপ্তর/অধিদপ্তর/সংস্থা/প্রকল্প থেকে
বদলি করে অন্য কোনো দপ্তর/অধিদপ্তর/সংস্থা/প্রকল্পে সরাসরি বদলি করা যাবে
না। মধ্যবর্তী সময়ে তাকে কোনো কলেজে ন্যূনতম ০৩ (তিন) বছর শিক্ষকতা করতে
হবে। নীতিমালার ১২ ধারায় বলা হয়েছে, একজন কর্মকর্তা সমগ্র চাকুরি জীবনে
০৬ (ছয়) বছরের বেশি দপ্তর/অধিদপ্তর/সংস্থা/প্রকল্পে কর্মরত থাকতে পারবেন
না।
কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ নীতিমালাকে যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে। এ বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি পদে তিন বছরের বেশি
সময় ধরে রয়েছেন সাত কর্মকর্তা। এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে এক যুগ পূর্তিও
হয়ে গেছে।
জানা গেছে, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ কলেজ পরিদর্শক
হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক মো. ফারাজ উদ্দিন তালুকদার। তিনি ২০২০ সালের ২৭
জুলাই সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ৫ আগস্ট তাকে ওএসডি
করা হয়। এরপর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৫ আগস্ট থেকে বোর্ডে ইনসিটু হিসেবে
কর্মরত রয়েছেন।
উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে অধ্যাপক মো. হারুন অর রশীদ মন্ডল যোগ দেন
২০১৫ সালের ৪ জুন। তিনি ২০২০ সালের ২৯ জুলাই সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক
পদে পদোন্নতি পান। ৪ আগস্ট তাকে ওএসডি করা হয়। এরপর থেকে প্রজ্ঞাপন
অনুযায়ী ৪ আগস্ট থেকে বোর্ডে ইনসিটু হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ২০১৫ সালের ২০
ডিসেম্বর উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগ দেন মো. মানিক হোসেন। ২০১০
সালের ৩ অক্টোবর সহকারী সচিব হিসেবে যোগ দেন ইব্রাহিম আজাদ। তিনি ২০১৩
সালের ২৬ মে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে ইনসিটু হিসেবে এখন পর্যন্ত
কর্মরত আছেন।
২০১০ সালের ২৩ মার্চ সহকারী কলেজ পরিদর্শক পদে যোগ দেন মো. আবদুল
মান্নান। ২০২১ সালের ২৯ জুন সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে
পদোন্নতি পান তিনি। এরপর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ওই বছরের ২৯ জুন থেকে বোর্ডে
ইনসিটু হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০১৮ সালের ২১ জুন বোর্ডে বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন বিসিএস
(সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এখন
পর্যন্ত তিনি শিক্ষা বোর্ডে একই পদে কর্মরত আছেন।
এদিকে নীতিমালা ভেঙে গুরুত্বপূর্ণ পদে একই কর্মকর্তারা বছরের পর বছর ধরে
থাকায় ক্ষুব্ধ বোর্ডের অন্য সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা নিজেদের
মধ্যে আলোচনায় এসব পদে পরিবর্তন আনার দাবি জানাচ্ছেন। তাদের মতে বোর্ডে
পদোন্নতিযোগ্য পদ রয়েছে, যা বোর্ডের বর্তমান কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই পূরণ
হতে পারে। বিষয়টি একাধিকবার প্রকাশ্যেও এসেছে। যদিও চাকরির ক্ষতি হওয়ার
শঙ্কায় এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে নারাজ অনেকেই।
গত আগস্টে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা
হয়, বোর্ডের মঞ্জুরিকৃত ১৬০টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৪৩টি। যার মধ্যে
পদোন্নতিযোগ্য পদ ১১টি এবং সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদ ৩২টি। এসব পদের মধ্যে
কম্পিউটার সেন্টারের ১০টি পদে নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন বা এ বিষয়ে
কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি বোর্ড কর্র্তৃপক্ষ।
একই পদে প্রায় এক যুগ ধরে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক
তোফাজ্জুর রহমান বলেন, আমি সরকারি চাকরি করি। সরকার যেখানে চাকরি করতে
বলবে আমি সেখানে করব। তবে আমার নিয়োগটি কত বছরের জন্য তা বলা নেই। আমি
যতদিন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করছি না, ততদিন সরকার আমাকে যেখানে চাকরি
করতে বলবে আমি সেখানে থাকব।
প্রায় একই ধরনের দাবি করেন কলেজ পরিদর্শক ফারাজ উদ্দিন তালুকদার। তিনি
বলেন, এমন কোনো নিয়ম নেই। সরকার যখন আমাদের সরাবে তখনই যাব। শুধু
চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিন বছরের নিয়মটি, বাকি কর্মকর্তাদের
ক্ষেত্রে তো দেখি না। এটা সরকারের এখতিয়ার, আমাদের অর্ডার করলে আমরা যেতে
বাধ্য।
উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ মণ্ডল বলেন, নিয়োগের নিয়ম
রয়েছে তিন বছর। কর্র্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে তিনের জায়গায় ছয় বছরও হতে পারে,
নয় বছরও হতে পারে। সব ক্যাডারের একই নিয়ম তিন বছর, এরপর পরিবর্তনের বিধান
আছে। সরকার চাইলে এখান থেকে পরিবর্তন হব।
আরেক উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মানিক হোসেন বলেন, সরকারি রুলস যেটা সব সরকারি
কর্মকর্তা যেকোনো স্টেশনে তিন বছর থাকবে, এরপর বদলির ব্যবস্থা করা হবে।
আমাদের চাকরির বিধিমালাতে এটি রয়েছে। কিন্তু সরকার আমাকে এখানে রেখেছে|
একটানা তিন বছরের বেশি সময় না থাকার বিধান থাকলেও এক যুগ ধরে কীভাবে আছেন
জানতে চাইলে সহকারী সচিব ইব্রাহিম আজাদ বলেন, এটা মন্ত্রণালয়কে বলবেন,
এটা আমাদের বলে লাভ আছে! ওখানে লেখা আছে সরকার যখন চাইবে তখন বদলি হবেন।
সরকারি বিধি অনুযায়ী একটানা তিন বছর এক পদে থাকার সুযোগ নেই বলে স্বীকার
করেছেন সহকারী কলেজ পরিদর্শক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, Avমি কি জোর করে
ধরে বসে আছি? সরকার আমাকে দিয়েছে, সরকার অর্ডার করেছে, আমি সরকারি আদেশে
আছি। সরকার যদি মনে করে আমি এখান থেকে চলে যাব। আমি কোনো নিয়ম জানি না,
আমরা তো ডেপুটেশনে আছি। আমরা তো স্থায়ী না, সরকার অর্ডার করলে চলে যাব।
এটাই তো নিয়ম|
বিদ্যালয় পরিদর্শক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, সরকার যতদিন রাখবে…
নিয়োগে বলা হয় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত। আমার আগের অনেক
কর্মকর্তা এখানে রয়েছেন। পদে রাখা বা বদলি করা সরকারের ব্যাপার।
সরকারি বিধি না মেনে একই পদে কর্মকর্তাদের বছরের পর বছর রাখার কারণ জানতে
চাইলে বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন,আমরা প্রতি মাসে
আমাদের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে
পারবে।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন