শূন্যের কোঠায় ফল আমদানি, রোজায় তীব্র সংকটের আশঙ্কা

শূন্যের কোঠায় ফল আমদানি, রোজায় তীব্র সংকটের আশঙ্কা

অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে রোজায় ফলের চাহিদা বাড়ে চট্টগ্রামে। কিন্তু আসন্ন রোজায় সেই ফল তেমন জুটবে না চট্টগ্রামবাসীর ভাগ্যে। কারণ চট্টগ্রাম মহানগরীর আমদানি করা ফলের পাইকারদের বড় আড়ত ফলমন্ডী এখন প্রায়ই খালি। গুটি কয়েক ফল নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছে ফলমন্ডী।

ফলে বাজারে ফলের পর্যাপ্ত সরবরাহও নেই। ডলার সংকটসহ নানা কারণে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে ফলের আমদানি। আমদানিকারকরা বলছেন, করোনাকালীন সময়েও যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কন্টেইনার ফল আমদানি হতো। সেখানে এখন প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ঠেকেছে ২০ কন্টেইনারে।

তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সকল ভোগ্যপণ্যের মতো ফল আমদানিতেও প্রভাব পড়ে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায় এই সংকট তৈরি হয়। এই সংকট দিন দিন বাড়ছে। ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে ফল আমদানি।

তিনি আরও বলেন, আমি নিজে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ কন্টেইনার ফল আমদানি করতাম। এখন আমদানি করছি ৫ থেকে ৬ কন্টেইনার ফল। ফলমন্ডীর আমদানিকারকরা প্রতি মাসে একসময় ১০০ কন্টেইনার ফল আমদানি করতেন। এখন সেই আমদানি নেমে এসেছে ২০ কন্টেইনারে। এতেই বোঝা যায় আমদানি কী পরিমাণে কমেছে।

এছাড়া আরেক সমস্যা হচ্ছে— অন্যান্য দেশের আমদানিকারকরা নষ্ট ফলমূল বন্দর থেকে ফেরত পাঠান সরবরাহকারীর কাছে। বাংলাদেশের আমদানিকারকদের সেই সুযোগ নেই। আমরা চট্টগ্রাম কাস্টমসে বিষয়টি জানালেও কোনো ধরনের সহযোগিতা মিলছে না। এলসি খোলার সুযোগ সৃষ্টিসহ এসব সমস্যা নিরসন না হলে ফল আমদানি বাড়বে না। আর সাধারণ ভোক্তারাও ভরা মৌসুমে চড়া দামে ফল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

শুধু ফলমন্ডী নয়, আমদানি কম হওয়ায় চট্টগ্রামের সবকটি বাজারে কমে গেছে ফলের সরবরাহ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারগুলোতে। চড়া দামে কিনে খেতে হচ্ছে ফলমূল। আসন্ন রমজানেও ফলের সরবরাহ পর্যাপ্ত রাখা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে ফলের দাম চলে যেতে পারে সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের বাইরে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আমদানি করা মাল্টা খুচরায় বিক্রয় হচ্ছে প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা, আপেল ২৭০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। ভালো মানের আপেল ৩০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। চীন থেকে আমদানি করা পাতাসহ কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকা থেকে ২৮০ টাকায়। আঙ্গুর প্রতি কেজি ৩৮০ থেকে ৩৯০ টাকায় বিক্রি হয়।

যদিও পাইকারি আড়ত ফলমন্ডীতে চীনা আপেল প্রতি কেজি পাইকারি রেট ১৭০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা। আবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা আপেল পাইকারিতে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, চীন থেকে আমদানি করা কমলা ১৮০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে প্রতি কেজি। প্রতিটি ফলের আইটেম পাইকারি ও খুচরায় দামের ফারাক হচ্ছে ১০০ টাকারও বেশি।

পাইকারির চেয়ে খুচরায় ফলের দামের বিস্তর ফারাক সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট কাঁচা বাজারের সামনে খুচরা ফল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, পাইকারদের কাছে ফল কিছুদিন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের মতো খুচরা ব্যবসায়ীদের তো সেই সুযোগ নেই।

পাইকারদের কাছ থেকে কেনা ফলমূল কয়েকদিনের মধ্যে বিক্রি করে ফেলতে হয়। তা না হলে পচে নষ্ট হয়। দুই কেজি নষ্ট হলে ব্যবসায় বিরাট ক্ষতি। তাই আমরা কিছুটা বাড়তি দামে ফল বিক্রি করি। যাতে নষ্ট হওয়া ফলের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারি। তবে বাজারে ফলের যে সংকট, তা রোজার মাসের জন্য অশনি সংকেত বলছেন কামাল উদ্দিন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফলমন্ডীর আড়তদার আবুল কালাম বলেন, বছরের এই সময় বিশেষ করে রমজানের আগ মুহূর্তে ফলের মজুদ বেশি থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে সেই পরিমাণ মজুদ নেই। কারণ আমদানি কমে গেছে। ক্রেতারা বাড়তি দামে ফলমূল কিনতে চান না। তাই আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা আমদানিতে নিরুৎসাহী হচ্ছি।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর ফলমন্ডী ফলের পাইকারদের বড় আড়ত হিসেবে পরিচিত। কদমতলী এলাকায় অবস্থিত বড় অংশজুড়েই ফলের বাজার। বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলমূলের বড় আড়ত হলেও দেশীয় বিভিন্ন ফলমূলও পাওয়া যায়। ভারত-মিয়ানমারের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চীন, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় নানা প্রজাতির ফলমূল। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের আমদানি করা খেজুরও পাওয়া যায় ফলমন্ডীতে।

বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা অন্য ফলমূলের মধ্যে আছে মাল্টা, আপেল, ডালিম, কমলা, আনার, আঙ্গুর, খেজুর এবং স্ট্রবেরি। ফলমন্ডীর ফলমূল চট্টগ্রামের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। পুরো বাজারের বিভিন্ন স্থানে সবসময় চার থেকে পাঁচটি ফলভর্তি ট্রাক থেকে খালাস চলে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা ফলমূলবোঝাই ট্রাক সরাসরি চলে আসে ফলমন্ডীতে। এরপর আমদানিকারকদের আড়ত বা গোডাউনে খালাস করা হয়।

সূত্র মতে, নতুন ও পুরনো ৩০০ ফলের আড়ত ও দোকান রয়েছে ফলমন্ডীতে। স্বাভাবিক সময়ে দিনে বিকিকিনি হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকার ফলমূল। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ও রোববার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। সপ্তাহের এ দুই দিনে বেচাবিক্রি হয় অন্তত দেড়শ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার ফলমূল।

আমদানিকারকরা জানান, ডলার সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকে এলসি খোলা আগের মতো হচ্ছে না। এ কারণে ফলের আমদানিও কমে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে সমুদ্রপথে আমদানি করা রিফাইন কন্টেইনারে করে আমদানি করা হয় ফলমূল। এসব আমদানি ফল কন্টেইনারে নষ্ট হলে সরবরাহকারীর কাছে ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই।

চট্টগ্রাম কাস্টমসকে ফল আমদানিকারকরা অনেকবার দাবি জানিয়েছেন আমদানি করা ফল নষ্ট পাওয়া গেলে সরবরাহকারীর কাছে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ জন্য অনেক আমদানিকারক এখন নিরুৎসাহী হচ্ছেন ফল আমদানি করতে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, বিদেশ থেকে রিফাইন কন্টেইনারে আমদানি করা ফল নষ্ট পাওয়া গেলে ফেরত দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সাপ্লায়ার বা রফতানিকারকের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট বা এনওসি লাগবে। এনওসি পাওয়া গেলে এনবিআরের ক্লিয়ারেন্সের জন্য কিছু প্রক্রিয়া আছে। এরপর নষ্ট ফলমূল সরবরাহকারীর কাছে ফেরত পাঠানো যায়। এনওসি ছাড়া আমদানিকারকের অনুরোধ অনুযায়ী ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন