মূল : ডক্টর কমার আব্বাস আমির খসরু তেরো শতকে জন্ম নেয়া এক অদ্ভ’ত শক্তিমান পুরুষ। যিনি খুব সহজভাবেই নিজেই নিজের ভিন্ন এক জগতকে নির্মাণ করেছিলেন। একজন মানুষের ভেতর গুণের এত সন্নিবেশ ভাবতেই কেমন অবাক লাগে। তাকে পাঠে বোধ ও চিন্তা যেন একটি অতল ষ্পর্শের দিকে হাত বাড়ায়। একজন কবি। যার কাব্যজগত এতই বিস্তৃত যে শ্লোক, বচন, ধাঁধা থেকে নিয়ে কখনো তাকে দেখা যায় বিয়েশাদীর কোন গীতযজ্ঞ অনুষ্ঠানে কখনো আবার হিন্দুস্তানের ফার্সি ভাষার মহাপণ্ডিতরূপে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তিনি এমনই কিছু সুর, তাল ও রাগের সৃষ্টি করেছেন যেগুলো ছাড়া সঙ্গীতকে অসম্পূর্ণ মনে…
বিস্তারিতTag: amir khusro
amir khusro | আমীর খসরু কি ইতিহাসবিদও ছিলেন? | দৈনিক আগামীর সময় | Agamirshomoy.com
আবুল হাসান ইয়ামীন উদ্দীন খসরু মধ্যযুগে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিদের একজন, সবচেয়ে বিখ্যাত বললেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি আমীর খসরু বা আমীর খসরু দেহলভী নামে অধিক পরিচিত। সুলতানী যুগে তিনি মুসলমানদের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সিসহ দিল্লি অঞ্চলের স্বদেশীয় হিন্দুস্তানি উপভাষা হিন্দভীতে লেখালেখি করেছেন। ফার্সি ও হিন্দভী ভাষায় তার কাব্যিক বাচনভঙ্গি ও সাবলীলতা তাকে তুতি–ই–হিন্দ বা ভারতের তোতাপাখি ও “ভারতের তুর্ক” উপাধিতে পরিচিত করে তোলে। আমীর খসরু সাতশত বছর ধরে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসের সংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। বর্তমান আলোচনায় আমরা তার সৃষ্টিকর্ম ঘেঁটে অতীতের সেই মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষকে বুঝে উঠতে তার রচনাগুলো আধুনিক ইতিহাস রচনার মান বিচারে ঠিক কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, তা জানতে চেষ্টা করব।
আমি এক হিন্দুস্তানি তুর্ক, আমি জবাব দিই হিন্দভীতে।
আরবিতে কথা বলতে নেই আমার মিসরীয় চিনি।
তার এ পরিণত কাব্যিক বোধ আর সচেতনতার প্রতিফলনের পশ্চাত্পটে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ছাঁপ খুবই স্পষ্ট।
মান তু শুদাম তু মান শুদি,
মান তান শুদাম, তু যা শুদি
তাকাস না গোয়ি বাদ আজি
মান দিগারাম তু দিগরি
— আমি তোমার হয়েছি, তুমি আমার হয়েছ
আমি তাই হয়ে গেলাম, তুমি যা হয়েছ
এরপর কেউ এ কথা বলতে পারবে না যে
তুমি অন্য কেউ, অথবা আমিও অন্য কেউ
আমীর খসরু তার লেখায় অনেক আত্মজৈবনিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত করলেও তার জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানা যায় না। বলা হয়ে থাকে তার বাবা সাইফুদ্দিন শামসী মধ্য এশিয়া থেকে এসে ভারতীয় এক মুসলমান ইমাদ আল-মুলকের কন্যাকে বিয়ে করেন। তখনকার দিনে তুর্কি থেকে আসা অভিবাসীরা অভিজাত গোষ্ঠীর ছিলেন। তারা সাধারণত ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলমানদের নীচু চোখে দেখলেও এ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃবিবাহের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। বলা হয়ে থাকে, খসরু তার এ উভয় বংশধারা নিয়ে গর্ববোধ করতেন এবং তার লেখা এ দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে প্রতীকায়িত করে। তাই সঙ্গত কারণেই তিনি নিজেকে একজন ‘ভারতীয় তুর্ক’ হিসেবে অভিহিত করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তখনকার দিনে ভারতে ‘তুর্ক’ উপাধিটি ছিল মুসলিম এর সমার্থক। খসরুর বাবা একজন নিরক্ষর ব্যক্তি হলেও তিনি তার সন্তানের উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করে যান। খসরুর বাবা আট বছর বয়সে মারা গেলে বালক খসরু তার মামা ও নানার কাছে লালিত-পালিত হন। শৈশবে নিজেকে গড়ে তোলার বছরগুলোয় তার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করা ব্যক্তিত্ব তার নানার সম্পর্কে তিনি গভীর আগ্রহ সহকারে লিখেছেন। এমনকি সাবালক হওয়ার আগেই তিনি ফার্সি ভাষায় কাব্য রচনা শুরু করেন। প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে তিনি আরবি ও ফার্সি উভয় ভাষাতে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। সম্ভবত সামান্য কথ্য তুর্কিও শেখেন এবং তিনি হিন্দভী ভাষাতেও সাবলীল ছিলেন।
মাত্র ১২ বছর বয়সে একজন পেশাদার লেখক হিসেবে খসরুর কর্মজীবনের সূত্রপাত। এ সময় তিনি তার পৃষ্ঠপোষকদের উদ্দেশে প্রশংসাসূচক পঙিক্ত রচনা করতে শুরু করেন। পরবর্তী দীর্ঘ ৫০ বছর জুড়ে ১৩২৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খসরু বিভিন্ন দরবারের একজন অভিজাত ব্যক্তি ও সভাকবির দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম দিকে অভিজাতবর্গ ও যুবরাজদের দরবারে পরবর্তী সময় তিনি দিল্লির সুলতানের দরবারে স্থায়ীভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি পাঁচজন শাসকের অধীনে কাজ করেন এবং আরো অনেক শাসন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ লাভ করেন।
ভারতের মধ্যযুগীয় কালপর্বে নিজস্ব সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা বিস্তারের প্রধান উপায়গুলোর মধ্যে প্রশংসাত্মক কাব্য ছিল শাসক গোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক হাতিয়ার। তাই পৃষ্ঠপোষকদের কাজকারবার ও চারিত্রিকগুণাবলি নির্মোহভাবে লিপিবদ্ধ করা দরবারের সভাকবিদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা কেবল শাসকের, তার শাসন ও শাসিতের, আদর্শিক ভাবমূর্তির প্রতিনিধিত্ব করতে দরবারে উপস্থিত থাকতেন। তবে পিটার হার্ডি বলেন, ‘দরবারের সভাকবি প্রশংসামূলক কাব্য রচয়িতা হিসেবে আমীর খসরুকে খারিজ করে দেয়াটা হবে নির্বুদ্ধিতা।’ এক্ষেত্রে এটা জেনে রাখাও অপরিহার্য যে আমির খসরু কেবল একজন সভাকবি ছিলেন না, বরং একাধারে তিনি ছিলেন একজন সুফী মরমিবাদী, বিখ্যাত সুফী সাধক নিজামুদ্দিন আউলিয়ার প্রিয়পাত্রদের একজন।
তার জীবদ্দশায় আমীর খসরু দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করে ভারতবর্ষ সম্পর্কে অঢেল জ্ঞান অর্জন করেছেন। তিনি এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি, উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন, পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে সংস্পর্শে আসা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সম্পর্কে বিশদভাবে জানার সুযোগ পান। আচরণ ও ব্যক্তিত্বে এমন এক বিস্তৃত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি, সমাজের প্রতি তার উদারতা ও মানবিকতা সহকারে নিজেকে বিলিয়ে দিতে বাধ্য এবং বাস্তবে তিনি তাই করে গেছেন।
এভাবে আমরা তার মধ্যে একাধারে একজন দরবারের অভিজাত, একজন মরমিবাদী সুফী, একজন পরিব্রাজকের সন্ধান পাই, যিনি তার রচনাগুলোর মাধ্যমে একজন কবি হিসেবে সবদিক থেকেই নিজের দায়দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে খসরুর এসব পরিচয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম জানা রয়েছে তার এ ধরনের একটি পরিচয়ও আমাদের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। খসরু কখনই নিজেকে একজন ইতিহাসবেত্তা বলে দাবি না করলেও দিল্লিতে চাকরিরত অবস্থায়, বিভিন্ন সুলতানের শাসনামলে, নিজ চোখে দেখা অনেক জিনিসের আর ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ তাকে নথিবদ্ধ করতে হয়েছে। তার এসব কাজ সেই সময়কার ইতিহাসের রসদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। আরো গভীরে প্রবেশের আগে তাকে উদ্ধৃত করে স্বল্পবিস্তর আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তার নহ সিফির-এ তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘নিজ চোখে আমি যা দেখেছি তাই বলেছি—অতীতের কোনো গালগল্প থেকে নয়।’ তার লেখার নৈতিকতা সবচেয়ে ভালোভাবে চিত্রিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত মসনভি, মিফাত–আল–ফাতেহ্–তে উল্লিখিত তার মন্তব্যগুলোর মধ্যে। তিনি বলেছেন, ‘যখন আমি এ কবিতা শুরু করলাম আর লেখার জন্য কলম প্রস্তুত করলাম, আমি একে এমনভাবে অলংকৃত করলাম যেন চরণ রচনার ক্ষেত্রে তা ছিল অপরিহার্য, কিন্তু যখনই আমি এমন কিছু যোগ করার কথা ভাবছিলাম, যা ছিল অসত্য। তখন সত্য এসে আমার হাতটা মুঠো করে চেপে ধরত। আমার মনও সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মেশানোর ধারণাতে উৎসাহ জোগাত না। কেননা মেকি অতিরঞ্জন একটি কবিতার ক্ষতি করতে পারে, সত্য সবসময়ই একটি প্রশংসনীয় জিনিস।’
আমীর খসরু তার নিজস্ব জ্ঞান ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকেই রাজা ও অভিজাতদের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। কায়কোবাদের সঙ্গে বুঘরা খাঁনের বৈঠক চলাকালে অওধের সুলতানের সহচর হিসেবে তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি এ ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করেন। একইভাবে খিলজির সুলতানের নাদিমদের একজন হওয়ায় সচরাচার গুরুত্বপূর্ণ মজলিশ সমূহে উপস্থিত থাকার সুবাদে তিনি জালাউদ্দিনের প্রথম দিককার অভিযানগুলোর বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। দুওয়াল রানী ও খিজির খাঁন, আলাউদ্দিন পরিচালিত দাক্ষিণাত্যের অভিযান সমূহের কথা এবং অসংখ্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ, বাজার নিয়ন্ত্রণ, মোঙ্গল নীতিসহ এ ধরনের আরো অনেক ঘটনার বর্ণনা তিনি লিখেছেন।
খসরুর প্রধান সৃষ্টিকর্মগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তার কাব্য সংগ্রহ পাঁচ দিওয়ান: তুফাত আল–সিঘার—বয়োসন্ধিকালের কবিতা, আসাত আল–হায়াত—মধ্য বয়সের কবিতা, ঘুরাত আল–কামাল—পরিণত বয়সের কবিতা, বাকীয়া–ই–নাকুঈয়া ও নাহাঈয়াত আল–কামাল; খামসা—তার মাতালা আল–আনোয়ার, শিরিন–ই–খুসরু, মাজনুন–লাইলা, আইনা–ই–সিকান্দারি ও হাশ্ত বিহিশ্ত নিয়ে সংকলিত; রাসা’ইল আল–ইজাজ বা ইজাজ–ই–খুসরু এবং পাঁচ রিসালা তার প্রবন্ধ সংগ্রহ।
অনেক ঐতিহাসিকের মতে তার মসনবিগুলো ইতিহাসের চেয়েও বেশি কিছু। কিরান আল–সাদাইন— দুই গ্রহের মিলন— তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, এটি ফার্সিতে রচিত এবং এতে তার গজলগুলোও অন্তর্ভুক্ত। এর প্রধান বিষয়বস্তু বুঘরা খাঁন ও তার ছেলে সুলতান মুইজুদ্দীন কায়কোবাদের মিলন, দ্বন্দ্ব ও তাদের সাহসিকতা। পাশাপাশি খসরু এখানে পালাক্রমে এ দুজনের সেনাবাহিনীর তথ্য, অওধের জলবায়ু, দিল্লি নগরের বর্ণনাও তুলে ধরেছেন।
খাজাইন আল–ফুতুহ্— বিজয়ের সম্পদ—এ তিনি সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির শাসনামল, তার জীবনযাপন প্রণালি, বিজয় অভিযান ও প্রশাসনিক দক্ষতার কথা তুলে ধরেছেন। এতে উল্লিখিত সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের বর্ণনা আধুনিক ঐতিহাসিকদের স্বতন্ত্র আগ্রহের কারণ হয়ে থাকতে পারে।
তুঘলক নামা হলো খুসরু খাঁনের বিরুদ্ধে গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের বিজয়ের বিশদ বর্ণনা। আশিকা দুওয়াল রানীওয়া খিজর খাঁন হলো আলাউদ্দীন খিজির খাঁনের পূত্র খিজির খাঁনর সঙ্গে নাহারওয়ালার রাজা কর্ণের কন্যা দুওয়াল রানীর প্রেমকাহিনীর বর্ণনা। নহ্ সিফির— নয় আসমান—এর মূল বিষয়বস্তু সুলতান কুতুবুদ্দীন মুবারাক শাহ্ খিলজির স্মরণীয় সব কর্মকাণ্ড হলেও বিবরণের বেশির ভাগই তার দরবার, উদ্ভিদ ও প্রাণিসম্ভারের বর্ণনা এবং ভরতবর্ষের ভাষা বৈচিত্র্যের কথা তুলে ধরতে দেখা যায়। তার সবশেষ কাজ মিফতাহ্ আল–ফাতেহ্ একটি মসনবি, এটি জালালউদ্দীন খিলজির যুদ্ধ অভিযান ও বিজয় সম্পর্কিত।
কেএ নিজামীর মতে, তার ঐতিহাসিক-কল্পনাবিলাসী মসনবি সমূহে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক এমন সব তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে, যার থেকে ঐতিহাসিকরা লাভবান হতে পারে: ‘আমির খসরুর রাজনৈতিক রচনাগুলো মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের সামাজিক ও সংস্কৃতিক ইতিহাসের তথ্যভাণ্ডারের একটি উৎস হিসেবে অধিষ্ঠিত। এসবে রয়েছে ভারতবর্েষর পশু-পাখি, ভাষা, ধর্ম, ফুল-ফল, পোশাক-আশাক, পর্দা, গহনাগাটি, অস্ত্রশস্ত্র, রীতিনীতি আর আচার-অনুষ্ঠানের বিশদ বিবরণ… যা আমাদের মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের প্রকৃত ছবি পুনর্নির্মাণে সহায়তা করে।’
আলোচনার মূল বিষয়বস্তু খতিয়ে দেখার পর এবার আরো বৃহত্তর প্রশ্নের দিকে যাওয়া যেতে পারে—ঠিক কোন ব্যাপ্তিতে আমরা খসরুকে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে পারি? তার আগে, এ প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন—একটি রচনাকে ইতিহাস ও একজন লেখককে একজন ঐতিহাসিক হিসেবে বিচার করতে হলে ঠিক কোন কোন নিয়ামকগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে?
ঐতিহাসিকরা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের গতিধারা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তার ধারণাগুলো হতে হবে বর্ণনামূলকের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্লেষণধর্মী। তার এ বিবরণ হবে কঠিন বাস্তবতা ও প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। ব্যক্তির বদলে তিনি গোষ্ঠীর প্রতিই অধিক মনোযোগী হবেন। ঐশ্বরিক কার্যকারণ বা এ ধরনের কোনো কিছুর বদলে তিনি মানব সিদ্ধান্ত ও সংস্থার কর্মকাণ্ডের প্রতি অনেক বেশি নজর দিবেন। এসব মাপকাঠির সঙ্গে খাপ খায় না বলে ঐতিহাসিকরা মধ্যযুগীয় লেখকদের সমালোচনা করেন। তার পরও মনে রাখতে হবে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এসব কলাকৌশল অতি সাম্প্রতি উদ্ভাবিত হয়েছে।
খসরুর রচনাসমূহ ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে প্রকৃত বাস্তব সত্যের খাতিরে হাতের নাগালে চলে আসতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক বারানি অতীতের ঘটনার বর্ণনায় বহুবার খসরু হতে উদ্ধৃত করেন। বারানির বহু রচনায় সম্পূরক হিসেবে আমীর খসরুর তুলে ধরা তথ্য প্রমাণ পরিবেশিত হতে দেখা যায়। এমনকি এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যেখানে বারানি নীরব থাকাকেই বেছে নিয়েছেন অথচ তা নিয়ে খসরু ছিলেন সরব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বারানি তুঘলক রাজবংশের উত্থান সম্পর্কে কোনো বর্ণনা না দিলেও এ সম্পর্কে খসরুর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
১৯২৭ সালে মোহাম্মদ হাবীব, খসরুর ঐতিহাসিক লেখাসমূহ নিয়ে সংলাপ, সঙ্গে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির শাসনামলের ইতিহাস নিয়ে রচিত খাজাইন আল-ফুতুহ্ এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে লিখতে শুরু করেন। যেহেতু তিনি মনে করতেন খসরুর এ রচনা ছিল কবিরুদ্দীনের রচনার একটি ধারাবাহিকতা। প্রয়োগিক দিক দিয়ে খসরুর রচনাসমূহ প্রথম যাচাইকারীদের মধ্যে পিটার হার্ডি ছিলেন প্রথম পণ্ডিত। তিনি তার অভিসন্ধর্ভের বিষয় হিসেবে খসরুসহ মোট পাঁচজন ইন্দো-পারসিক ঐতিহাসিককে বেছে নেন, যারা চৌদ্দ শতাব্দী হতে সালতানাতের ইতিহাস প্রণয়ন করেছেন।
পিটার হার্ডি প্রতিপন্ন করেন যে খসরু ইতিহাসবেত্তা ছিলেন না, যেহেতু অতীত বর্ণনার মাঝে বিষয়বস্তুর একতা ও ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। হার্ডির মতে, ‘কোনো ব্যবহারিক, নৈতিক, ধর্মীয় বা শিক্ষায়তনিক উদ্দেশ্যে নয় বরং কেবল নান্দনিক অভিপ্রায়ে খসরু অতীত সম্পর্কে লিখেছেন।’ তাই তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে তিনি ছিলেন শুধুই একজন কবি। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে খসরু তার লেখায় কখনই ইসলামিক-ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে কোনো ব্যাখ্যা অনুসন্ধনে যত্নবান ছিলেন না। একজন মুসলিম হিসেবে খসরু মুসলিম লোককাহিনী ও ধর্মীয় লোকবিদ্যার বিশাল এক সম্পদে সমৃদ্ধ গৃহ হতে কথাচিত্রণে সক্ষম হন। তিনি ভারতীয় মুসলমানদের সর্বজনীন সংস্কৃতির মালিকানার ধ্যানধারণা প্রবল করে তুলতে সক্ষম হন, যাতে তারা নিজেদের শুধু মামুলি কোনো স্থানীয় অভিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে না। তবে হার্ডি তাার এ গবেষণায় মুসলমানদের কাছে গুরুত্ববহ ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহ অনুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখেননি। বরং তিনি কেবল এদের কল্পনা ও ভাববিলাসিতাকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি খসরুর পৃষ্টপোষকদের নিজস্ব অসার আত্মশ্লাঘা ও নিরর্থক আত্মগরিমার প্রতি খুব কমই গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
কীভাবে একজন দরবারি ঐতিহাসিকের অবস্থানে থাকায় খসরুর ইতিহাস রচনা প্রভাবিত হয়েছে, হার্ডি সেই ব্যাখ্যাও দাঁড় করার চেষ্টা করেছেন। খসরুর রচনা সমূহের মাঝে প্রায়ই উল্লেখ পাওয়া যায়, সুলতানের অনুরোধেই কেবল তিনি লিখতেন আর তাই বলা যায় তিনি মূলত লিখতেন ক) সুলতানকে নজর কাড়তে, খ) সুলতান ও তার প্রশাসন সম্পর্কে আদর্শ একটি চিত্র তুলে ধরতে ও গ) শাসক বা তার যেকোনো কর্মপন্থার সমালোচনা থেকে নিজেকে নীরব রাখতে।
আধুনিক ইতিহাসতত্ত্ব অনুসারে আমির খসরু ইতিহাস লেখেননি। তিনি শুধু তার আগ্রহের বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু এসব করতে গিয়েই তিনি আধুনিক ইতিহাসবিদদের জন্য বিপুল পরিমাণ তথ্য রেখে গেছেন। বিশেষত তথ্য উপস্থাপনে তিনি যথেষ্ট সততার পরিচয় রেখে গেছেন। তার পক্ষপাতিত্ব, স্তুতি রচনাকে মাথায় রেখে বিশ্লেষণ করলে আমির খসরুর রচনা থেকে সুলতানি আমলের ভারতবর্ষের ইতিহাস পুনর্নির্মাণ সম্ভব।