কাব্য ও সঙ্গীতের কীর্তিমান পুরুষ আমির খসরু

মূল : ডক্টর কমার আব্বাস

আমির খসরু তেরো শতকে জন্ম নেয়া এক অদ্ভ’ত শক্তিমান পুরুষ। যিনি খুব সহজভাবেই নিজেই নিজের ভিন্ন এক জগতকে নির্মাণ করেছিলেন। একজন মানুষের ভেতর গুণের এত সন্নিবেশ ভাবতেই কেমন অবাক লাগে। তাকে পাঠে বোধ ও চিন্তা যেন একটি অতল ষ্পর্শের দিকে হাত বাড়ায়। একজন কবি। যার কাব্যজগত এতই বিস্তৃত যে শ্লোক, বচন, ধাঁধা থেকে নিয়ে কখনো তাকে দেখা যায় বিয়েশাদীর কোন গীতযজ্ঞ অনুষ্ঠানে কখনো আবার হিন্দুস্তানের ফার্সি ভাষার মহাপণ্ডিতরূপে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তিনি এমনই কিছু সুর, তাল ও রাগের সৃষ্টি করেছেন যেগুলো ছাড়া সঙ্গীতকে অসম্পূর্ণ মনে হয়। তান সিন তাকে নায়ক ও সরদাররূপে গণ্য করতো। আধ্যাত্ম সাধনায় মগ্ন ছিলেন। একজন সাধকরূপেই শেষ জীবনে নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন সূফি জীবনে। ছিলেন হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহ. এর আধ্যাত্মিক ভাবশিষ্য। খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া আমির খসরুতে এতোটাই মুগ্ধ ছিলেন যে খাজা সাহেব নিজেই বলেছেন, ‘‘যদি আমাকে ঈশ্বর প্রশ্ন করেন, কি নিয়ে এসেছো। বলবো, খসরুকে।’’

আমির খসরু একজন ঐতিহাসিকও। তার প্রণীত ইতিহাসের ধারা এতোটাই সমৃদ্ধ যে কাব্য, গদ্যের ইতিহাস রচনায় তাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ণ করা হবে। অনুসন্ধ্যান ও নিরেট তথ্যের যোগসাজশে তিনি রচনা করেছিলেন তার অমূল্য সব ঐতিহাসিক গ্রন্থ। বাবা ছিলেন তুর্কি বংশীয়। মা ভারতীয়। যাপিত জীবনে ইরানি প্রভাব ছিলো বেশ। তাই তুর্কি, ইরানি আর হিন্দি সংস্কৃতির সমন্বিত রুচির এমন একটা অভূতপূর্ব সংশ্লেষ তার মাঝে বিম্ভিত হয়েছিলো, যা তাকে একজন বিশেষ ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আরবি, ফার্সি, তুর্কি, হিন্দী, পাঞ্জাবি, সিন্ধী, সংস্কৃতের মতো অসংখ্য ভাষায় দারূণ দখল ছিলো তার। জৌর্তিবিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী। বেশ ক’জন বাদশাহর রাজ্যকালই শুধু দেখেননি। ছিলেন রাজসভার সম্মানিত ও বিদ্বানদের অন্যতম। সেই মহাপুরুষ কবি আমির খসরু। আজ যখন তার মৃত্যুর ৭৫০ হতে চলছে তখন ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সঙ্গীতে এক মহান প্রতিভ’ হয়ে সমাসীন আছেন। ইতিহাস যাকে এক অতুলরূপেই নিজের ভেতর ধারণ করেছে। কালে কালে তার কথা এভাবেই বিবৃত করেছে জনমানসের মাঝে।

আমির খসরু ভারতের উত্তর প্রদেশের ইহাত জেলার পাতিয়ালা গ্রামে ( এটিকে মুমিনপুর বা মুমিনাবাদ নামেও ডাকা হয়) ১২৫৩ সাল ও হিজরি ৫২ সনে জন্মগ্রহণ করেন। তার সঠিক জন্মতারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। পিতার নাম আমির সাইফুদ্দিন। যিনি দিল্লীর সম্রাট সুলতান ইলতুৎমিশের রাজ্যসভার উচ্চপদস্থ কর্মকতা ছিলেন। সেই সাথে পাতিয়ালা গ্রামের জায়গিরও ছিলেন তিনি। চেঙ্গিস খানের শাসনামলে হত্য, লুন্ঠন, বর্বরতা এবং জীবননাশের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেতে মার্তৃভ’মি তুর্কিস্থান ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। সেসময় ভারতে সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের শাসনামল চলছিলো। সাইফুদ্দিন ছিলেন একজন সাহসী বীর যোদ্ধা। অশ্ব চালনায় তার খ্যাতি ছিলো ব্যাপক। সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের তার এ বীরত্ব ও সাহসিকতা খুবই মনে ধরলো এবং তিনি তাকে তার কাছে টেনে নেন। এভাবেই ধীরে ধীরে সাইফুদ্দীন সুলতানের সভা সদস্যদরে একজন হয়ে ওঠেন।

খসরুর মাতা বিবি দৌলত নাজ। তিনি ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজপুত রাওয়াত আরজের কন্যা। ইমাদুল মূলক রাজপুত রাওয়াতের অধীনে ছিলো ১০০০০ সেনা। এবং তিনি ছিলেনও বাদশাহর নৈকট্যভাজনদের একজন। সাইফুদ্দিনের সন্তানদের মধ্যে এজাজ উদ্দীন ( কোথাও তাকে এজাযুদ্দীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে) সবার বড়। বাবার মৃত্যুর পর তারই স্থালাভিষিক্ত নিযুক্ত হয় সে। আরবী ও ফার্সিতে তার দখল ছিলো বেশ। ছেলেদের মধ্যে হিসামুদ্দীন সবচেয়ে ছোট। সে ছিলো বাবার মতোই শক্তি,সাহস আর তরবারী চালনায় প্রসিদ্ধ। সেই মূলত ‘‘আবুল হাসান ইয়ামিনুদ্দিন’’ অর্থাৎ আমির খসরু। নির্ভরযোগ্যতা বা ইতিহাসে এর সত্যতা নিয়ে সামান্য প্রশ্ন থাকলেও আমীর খসরুর জন্মের সময়ের একটি কথা খুবই প্রসিদ্ধ যে, ‘‘খসরু যখন জন্মগ্রহন করে তখন তাকে এক সূফির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সূফি তাকে এক পলক দেখেই বলে, যে শিশুকে আজ আমার কাছে আনা হয়েছে সে একদিন খাকানীকেও ( ইরানের প্রসিদ্ধ একজন কবি) অতিক্রম করে আগে বেড়ে যাবে।”

একজন সাধকরূপেই শেষ জীবনে নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন সূফি জীবনে। ছিলেন হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহ. এর আধ্যাত্মিক ভাবশিষ্য। খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া আমির খসরুতে এতোটাই মুগ্ধ ছিলেন যে খাজা সাহেব নিজেই বলেছেন, ‘‘যদি আমাকে ঈশ্বর প্রশ্ন করেন, কি নিয়ে এসেছো। বলবো, খসরুকে।’’

পিতার কাছে খসরুর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা। বাবা নিজের তত্বাবধানে রেখেই তাকে শিক্ষাদীক্ষা দিচ্ছিলেন। নিজে তেমন শিক্ষিত না হলেও সন্তানের পড়াশুনার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। ব্রতী হলেন যত পয়সাই লাগুক ছেলেকে সে উচ্চ শিক্ষিত বানাবে। ক্রমে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে খসরু বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। এবং সেসময় সুন্দর হস্তালিপির প্রতি তীব্র মুগ্ধতা চলে আসে তার। অবশ্য এর কারণ হলো তার বাবা তাকে তৎকালীন প্রসিদ্ধ আলেম এবং মান্যবর লেখক মাওলানা সায়ীদ উদ্দীনের তত্বাবধানে দিয়েছিলেন। এছাড়া কাব্যের প্রতি তো তার আসক্তি ছিলো সবচেয়ে বেশী। এবং তখনই খুব সহজেই ছন্দ বাঁধা তার জন্য কঠিন কোন বিষয় ছিলো না। একবার হলো কি খসরুর উস্তাদ এবং বিখ্যাত লেখক কাজী আসাদুদ্দীন তার প্রিয় শিষ্যকে নিয়ে গেলেন সেসময়ের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ,জ্ঞানী, ধীমান ব্যক্তি আজীজুদ্দীনের বাড়ী। তখন তিনি কোন একটা বই পড়ছিলেন। উস্তাদ আসাদুদ্দীন স্বীয় শিষ্যর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, ‘‘এই ছেলেটি অত্যন্ত মেধাবী। আপনি তাকে কিছু পড়িয়ে দিন।” তখনই আজীজুদ্দীন খশরুর হাতে কিতাব দিয়ে বললো , এখান থেকে কিছু পড়ো। খসরু কাব্যছন্দের এমনই আনন্দম সুর ও তীক্ষ্ণ মেধার প্রদর্শন করলো আজীজুদ্দীন প্রভাবিত না হয়ে পারলো না। এরপর সে আবার তাকে বললো, নাও! এখন তোমার মূল পরীক্ষা শুরু। পরীক্ষাটি ছিলো অদ্ভ’ত। তাকে এমন চারটে জিনিসের নাম বলা হলো, যেগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার সামান্য মিল নেই। এবং তাকে বলা হলো এগুলোকে কবিতায় গেঁথে দেখাও। চারটি বিষয় ছিলো- কেশ, ডিম, তীর এবং তরমুজ। খসরু কাল বিলম্ব না করে মুহুর্তের মধ্যেই এক চতুষ্পদী শ্লোকেই এগুলোকে বেঁধে শুনিয়ে দেয়। আজীজুদ্দীন এই শিশুর এমন কাব্য প্রতিভা ও মেধা দেখে যারপরনাই আশ্চর্য হন। প্রশংসা করে বলেন,‘‘ কালে অন্যান্য কবিদের চেয়ে তোমার দ্বিগুণ প্রসিদ্ধি হবে’’।

তার বয়স যখন সাত কি আট তখন তার বাবার মৃত্যু হয়। তাই খসরুর প্রতিপালনের দায়িত্ব তার মা ও নাানার কাধেই বর্তায়। তাদের বাগডোরে থেকেই শিশু খসরু বেড়ে উঠতে শুরু করে। নানা ছিলেন তার সময়কার একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি। তাকে বলা হতো দিল্লীর ‘‘উযিরে ইমাদুল মূলুক’’। তিনি ইলতুৎমিশ থেকে গিয়াসুদ্দীন বলবনের শাসনামল পর্যন্ত দেখেছিলেন। এবং এসব বাদশাহদের দরবারে অত্যন্ত প-িত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিলেন। ভারতীয় ক্লাসিক সঙ্গীতের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো। সঙ্গীত ভালোবাসতেন এবং টাকা পয়সার কোন অভাবই ছিলো না । যে কোন শখ হলে তা পূর্ণ করতেন। মোটকথা তার সঙ্গীতপ্রীতির কথা শুনে দূরদূরান্ত থেকে গায়করা তার এখানে এসে ভিড় করতো এবং জমিয়ে গানের আসর বসতো।

ইতিমধ্যে আবুল হাসানের (খশরু) রাজ দরবার, জ্ঞানার্জন, সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরী হয়। আবুল হাসান নিয়মিত ঘর ও ঘরের বাইরে যেতে পছন্দ করতেন। শুধু পছন্দই না বরং এটিকে প্রাত্যাহিক রুটিনে করতে চাইতেন। নানার তত্বাবধানে খুব দ্রুতই তার পড়াশুনা এগুতে লাগলো। নানাজান দেখলেন তার নাতি শুধু কেবল পড়াশুনাতেই মেধাবী নয় বরং খেলাধূলার প্রতিও তার একটা আগ্রহ আছে। তিনি তাকে সেমতেই সুযোগ সুবিধে করে দিচ্ছিলেন। এভাবে খসরুর যৌবনে পদার্পনের শুরুভাগেই ১২৭১ তার নানা শেষ নিদ্রা লাভ করেন। এসময়ের মধ্যে খসরু নানান সব বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করে ফেলেন এবং দক্ষ হয়ে উঠেন। বিশেষত কাব্য শাস্ত্রে এমন পা-িত্য অর্জন করেন যে তখনই তার বেশ কিছু কবিতা এমন প্রসিদ্ধ হয় , যেগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গায়করা গাইতে শুরু করে। এর মাধ্যমে খসরু ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে গলিগুঁজি ও পথে পথে ছড়িয়ে পড়ে। নানার মৃত্যুর পরে তার জীবনের উথ্থান পতনের সময়টা বেশ কঠিন ছিলো। কিন্ত বাবা ও নানার দীক্ষা পাওয়া খসরু কঠিন অবস্থায় ভেঙ্গে যাবার পরিবর্তে সময়কে প্রতিহত করেন। এবং বুক টান করে সমস্ত অবস্থার সম্মুখে দৃঢ়পদ অবিচল থাকেন। পূর্ণ যৌবনে প্রবেশ করতে করতেই খসরু ফার্সি সাহিত্য ও কাব্য শাস্ত্রের কয়েক ধাপ পেরিয়ে তার শক্তির ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। অবশ্য এর কারণও ছিলো, ছোট থাকতেই সে ফার্সি ভাষার নামকরা কবি আনুরি, সিনাই, এবং খাকানি ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ কবিদের সব লেখাই পড়ে শেষ করেছিলেন। এবং ছন্দ গাঁথা ও চতুস্পদ স্লোকে কবিতা বলাকে তার জন্য কোন কঠিন কিছুই ছিলো না। অনুসন্ধিৎসু মন, ব্যাপক আগ্রহ, গভীর পড়াশুনা, সূফিদের সান্মিধ্য এবং জীবনাচারে কাব্যের প্রভাব, এসব বিষয়গুলো পরবর্তী জীবনে তাকে প্রতি পদে পদে সাহায্য করেছিলো।

১২৭৩ সালে তার প্রথম গ্রন্থ ‘‘তুহফাতুস সিগার’’ প্রকাশের সাথে সাথেই খসরুর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মুখে মুখে তখন শুধু তারই কথা। সেসময় সুলতান বলবনের ভাতিজা, মালিক আলাউদ্দীন কিসলু খাঁ-র রাজ কর্মচারি ছিলো। অন্যদিকে খসরুর নানা যেহেতু বিভিন্ন বাদশাহদের শুধু কেবল নৈকট্যভাজনই ছিলেন না বরং রাজসভার গুরুত¦পূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। এবং তার সাথে খশরুও রাজ দরবারে আসা-যাওয়া করতো, তাই নানার মৃত্যুর পর স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপনের জন্য রাজ দরবারের চেয়ে উপযুক্ত আর কোন জায়গা ছিলো না। মালিক আলাউদ্দীন কিসলু খাঁ দানবীর এবং জ্ঞানী ব্যক্তির হওয়ার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সান্মিধ্য প্রাপ্ত ছিলেন। পাশ্ববর্তী রাজ্যসমূহেও তার বেশ প্রসিদ্ধি ছিলো। খসরু ধীরে ধীরে দরবারের সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত হলেন অনেক সময় তার অনুপুস্থিতে কিশলু খাঁ-র দরবার শুন্য শুন্য অনুভূত হত। এভাবে প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হয়। এক সন্ধ্যায় কিশলু খাঁ সামানার হাকিম বাগরা খাঁ-কে তার বৈঠক খানায় নিমন্ত্রণ করেন। বাগরা খাঁ সাথে তার বৈঠকের প্রসিদ্ধ কবি শামসুদ্দীন দাবির এবং কাজী আসিরকেও সঙ্গী করে নেন। দরবারে মাহফিলের আয়োজন করা হয়। বাগরা খাঁ-র দরবারি কবি সেখানে খুব কবিতা পাঠ করলেন এবং শ্রোতাদের বাহবা পেলেন। এরপর খসরু যখন তার কবিতায় সুর ধরলো তখন পুরো মাহফিলই যেন তার বীণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। প্রতিটি শব্দ ও পঙক্তির উচ্চারণে উপস্থিত সকলেই খসরুর কবিতার প্রেমে পড়ে গেল। খসরুর শ্রুতি মধুর কবিতা পাঠে বাগরা খা-ঁও মুগ্ধ ও অভিভ’ত হন। তার কাব্য সুষমা ও পাঠে মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরস্কার দ্বারা সম্মানিতও করেন। খসরুও বাগরা খাঁ’র পুরস্কার সাদরে গ্রহন করেন। কিন্ত খসরুর এ এনাম গ্রহণ কিসলু খানের মোটেও পছন্দ হয়নি। তিনি মনোক্ষুন্ন ও খসরুর উপর অসন্তুষ্ট হলেন। পরে অনেকভাবেই খসরু কিসলু খাঁ-কে বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছে। কিন্ত এতেও কিসলু খাঁ-র মন গলেনি। একপর্যায়ে কথার বনিবনা না হওয়ায় খসরু তার দরবার পরিত্যাগ করে বাগরা খাঁ’র সান্মিধ্যে চলে যান।

একজন কবি। যার কাব্যজগত এতই বিস্তৃত যে শ্লোক, বচন, ধাঁধা থেকে নিয়ে কখনো তাকে দেখা যায় বিয়েশাদীর কোন গীতযজ্ঞ অনুষ্ঠানে কখনো আবার হিন্দুস্তানের ফার্সি ভাষার মহাপণ্ডিতরূপে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তিনি এমনই কিছু সুর, তাল ও রাগের সৃষ্টি করেছেন যেগুলো ছাড়া সঙ্গীতকে অসম্পূর্ণ মনে হয়।

তখন ১৩৭৯ সাল। গিয়াসুদ্দিন বলবন বাগরা খাঁ-কে বাঙলা অঞ্চল আক্রমণে পাঠালেন। বাগরা খাঁ তখন আমির খসরুকেও তার সঙ্গে নিয়ে নেয়। এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাগরা খা বাঙাল আক্রমণ করে এবং সবকিছু তছনছ করে দেয়। রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকই তখন বাগরা খাঁ’র ভয়ে আতঙ্কিত। কিন্তু আমির খসরুর বাগরা খাঁ’র এ বর্বোরোচিত হামলা একদমই পছন্দ হয়নি। তিনি অত্যন্ত দুঃখী হলেন এবং বাগরা খার সঙ্গ ত্যাগ করতে মনস্থির করলেন। ঘটনাক্রমে সেদিনই তার মায়ের অসুখ বেড়ে যাওয়ার সংবাদ আসে। খসরু খুবই বিচলিত হয় এবং যাওয়ার বন্দোবস্ত করে। খসরু বাগরা খাঁ-কে জানায় এখন আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। ওদিকে আবার শামসুদ্দিন দাবিরও খুব করে চাচ্ছিল খসরু তার কাছে অবস্থান করুক। খসরু এ প্রস্তাব গ্রহণ করেনি এবং এটিকে সুযোগ মনে করে বাগরা খাঁ-র সঙ্গ পরিত্যাগ করে ওখান থেকে চলে আসে।
১২৮০-৮১ সালে বলবানের বড় ছেলে এবং মুলতানের শাসক সুলতান মুহাম্মদ, আমির খসরুর সুখ্যাতি ও প্রশংসা শুনে প্রভাবিত হন। এবং তাকে তার দরবারে বিশেষ কবি পদে অধিষ্ঠিত হবার প্রস্তাব পেশ করেন। সেসময় মুলতানকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ মনে করা হত। খসরু তাই তার এ প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয় এবং দরবারে প্রবেশ করে। রাজদরবারে খসরুর প্রশংসা, স্ততি এবং তার জ্ঞানের পরিধিতে সবাই প্রভাবিত হতে শুরু করে। সকলেই তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখত। এসময় খসরু কাব্যশাস্ত্র ও সঙ্গীতের দিকে আরো গভীরভাবে মনোযোগী হয়ে উঠেন এবং তিনি তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘‘ওসতুল হায়াত’’ সংকলন করেন। খসরু ভারতীয় সঙ্গীতে আরবী সুরের প্রচলন ঘটায়। শুধু তাই নয় বরং আরবী ও তুর্কি স্বরের সমন্বয়ে পাঞ্জাবিরা গীত শাস্ত্রে নতুন এক রসের সন্ধান পায়। এসব তো একাধারে করেছেনই এরসাথে সাথে তখন তিনি আরবী ও আইনশাস্ত্রে গভীরভাগে মনোযোগ দেন। এবং দেখতে দেখতে এ ব্যস্ততাতেই চার পাচ বছর কেটে যায়।

একদিন সুলতান মুহাম্মদের কাছে খবর এলো মোগল সরদার তৈমুর খাঁ রাজ্যের উপর হামলা করেছে। তিনি তৎক্ষনাত সৈন্যসামন্ত নিয়ে মুলতান থেকে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। দু’পক্ষের তুমুল লড়াই শুরু হয় এবং সুলতান মুহাম্মদের সৈন্যরা মোঘল সৈন্যদের পর্যদুস্ত করে। পিছু হটতেই সৈন্যরা যখন দেখলো বিজয়ের নেশায় সুলতান মুহাম্মদের মাতাল সৈন্যরা অসতর্ক হয়ে পড়েছে। তখন তারা পেছন থেকে অতর্কিত হামলা করলো এবং যুদ্ধের চেহারাই পাল্টে দিল। মুহুর্তেই যুদ্ধের এই পট পরিবর্তনে সুলতানের সৈন্যরা মোঘল সৈন্যদের মোকাবেলায় ব্যার্থ হলো। এদিকে সুলতান মুহাম্মদ ও ফিরে এসেছিলেন এবং মৌঘল সৈন্যরা তার অসংখ্য যোদ্ধাকে বন্দী করে নিয়ে গেল৷দূভার্গবশত বন্দীদের মাঝে আমীর খসরুও ছিলো। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলা চলে কয়েদ খানা থেকে খুব দ্রুতই সে মুক্তি পায়। এবং প্রথমে দিল্লি তারপর তার মায়ের কাছে পাতিয়ালায় চলে আসেন। ১২৮৫ সালে আমির খসরু হাকিমে উদ, আমীরে আলা সারজানদার খাঁ-র সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি লাগাতার দু’বছর অবস্থান করেন। সেখানে তার জন্য সব রকম আরাম আয়েশের ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু একটা সময়ের পর খশরুর অশ্বস্তি হতে লাগলো এবং খুব করে দিল্লির কথা মনে পড়ে তার কষ্ট হত। তাই তিনি সেখান থেকে দিল্লীতে ফিরে আসতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

জানদার খাঁ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সে যেন না যায়। কিন্তু খসরু কোনভাবেই জানদার খাঁ-র কথা রাখতে না পেরে দিল্লী চলে আসে। দিল্লীতে তখন কায়কোবাদের শাসন। কায়কোবাদ কিছুকাল পূর্বেই তার পিতা বাগরা খাঁ-র সঙ্গে এইরকমের ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছে যে উভয়পক্ষের সৈন্যরাই যুদ্ধাংদেহী মনোভাব পোষণ করে আছে। দুই দলের কিছু অভিজ্ঞ সৈন্য এবং জ্ঞাানী লোকের মধ্যস্থতাই তাদের আটকে রেখেছিল শুধু। কায়কোবাদ তখন তার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করলো সে যেন এসব ঘটনা কবিতা আকারে লিখে দেয়। অবশেষে খসরু কায়কোবাদের অনুরোধ রক্ষা করেন। এবং চার হাজার কবিতার একটি কাব্য সংকলন ১২৮৮-এর শেষের দিকে ‘‘কিরানুস সাআদাঈন’’ নামে রচনা করেন। কায়কোবাদ খসরুর এই কাজে এতোটাই খুশী হলেন যে তাকে ‘‘মুলকুশ শুআরা’’ খেতাবে ভূষিত করেন। ১২৯০ সনে কায়কোবাদের মৃত্যু হলে তার ছেলে কায়কোওাস রাজ্যের শাসনভার গ্রহণে আসেন। কিন্তু তার অপরিপক্ষ শাসনব্যবস্থা তিন মাসের বেশী টিকতে পারেনি। তারপর জালালুদ্দীন খিলজী মসনদে আসেন। সে কবি ও কবিদের স্ততি গ্রহণকারী ছিলো এবং তার চারপাশে কবিদের ভিড়ও ছিলো প্রচুর। তবে খসরুকে খিলজীর দরবারে প্রবেশ করতে কোনরকম বেগই পোহাতে হয়নি। জালালুদ্দিন খিলজীর দরবারে তখন খসরুর বন্ধু প্রসিদ্ধ কবি হাসান সানজারিও ও ছিলো। এ দুই কবি খুব অল্প সময়েই ১২৯১ সালে খুব কাছের ঘনিষ্টজন হিসেবে খিলজীর নৈকট্য লাভ করেন। এসব মিলিয়ে খুব ভালোভাবেই দিনগুলোই কেটে যাচ্ছিলো এবং খসরুর অধ্যায়ন ও জারি ছিলো। এসময় খসরুর আরেকটি ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থ ‘‘মিফতাহুল ফুতুহ’’ প্রকাশিত হয়৷ এরই মধ্যে তিন বছর অতিবাহিত হয়ে যায় এবং ১২৯৪ সালে খসরু তার সৃষ্টি জীবনের অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ‘‘গুররাতুল কামাল’’ সংকলন করেন।

খাজা আলতাফ হোসেন আলি ‘‘ইয়াদগারে গালিবের’’ সমাপ্তি যে পাঁচটি লাইনে করেছেন। সেখানে ওই তিন মহান ব্যক্তির বৈশিষ্টের কথা এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘‘এই সমস্ত বিষয়াদির উপর গভীর দৃষ্টিপাত করে মির্জা গালিবের ব্যাপারে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সাহিত্যিক যোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে সব্যসাচি আমির খসরু ও ফয়জির পর মির্জা গালিবের মত ভারতের মাটিতে আজ পর্যন্ত কেউ জন্মেছে!

রাজা বাদশাহদের ব্যাপারে একটি প্রসিদ্ধ বচন হলো, ‘‘রাজচক্ষু সাধারণত অনুগতের অন্ধ স্ততি কামনা করে, যেখানে নৈকট্য অবজ্ঞায় রূপ নিতে মুহুর্তকাল লাগে না’’। এমনকিছুই ১২৯৬ সালে খিলজীর সাথেও হয়েছিল। খিলজীর ভাতিজা আলাউদ্দিন, খিলজীকে হত্য করে ক্ষমতার নেশার চূর হয়ে নিজেকে মহারাজ বলে ঘোষণা করেন। আমির খসরু প্রয়োজন ও সময়ের অপেক্ষা করে সেসময় চুপ ছিলেন। আর সেসময়েই আমির খসরু নিজামুদ্দিন ও ১৩০২ সালে সাত আউলিয়ার নৈকট্য গ্রহণের সুযোগ পান। এর মাঝে ১২৯৯ সনে তার কাব্য সংকলন ‘‘মাতলাউল আনওয়ার’’ এবং ১৩০০ সনে ‘‘আয়েনায়ে সিকান্দারি বেহশত’’ বেরুয়। যা তাকে তার মুর্শিদ ও গুরু খাজা নিজামুদ্দিনের বিশেষ দৃষ্টিতে নিয়ে আসে। এবং এটা ওই বছরই ছিলো যে বছর খসরু তার আধ্যাত্মিক গুরুর অমৃত বাণীসমূহ একত্রিত করতে মনস্থির করেন।

এদিকে সময়ের এ অশৃঙ্খলতা এবং নোংরাভাবে রাজ্যের পাট পরিবর্তন খসরুকে খুবই অস্থির করে তুলেছিলো। তার মন ও ইচ্ছাশক্তি হাঁপিয়ে ওঠেছিলো। একটু শান্তির অবসাদ গ্রহণে তার আধ্যাত্মিক গুরু খাজা নিজামুদ্দিনের দরবারের চেয়ে আর কোন উত্তম স্থান তার মনে ধরলো না। সুতরাং খসরু তখন পরিপূর্ণরূপে খাজার সান্মিধ্যে চলে গেল। এখানে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ইতিহাসে আছে, একবার খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া অসুখে পড়লেন। নিয়মিত চিকিৎসা চলছিলো তবুও তিনি সেরে উঠছিলেন না। বরং অসুস্থতা যেন ক্রমেই বাড়তে লাগলো। আমির খসরু তখন নিজের মুর্শিদ, খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মনোপ্রশান্তির জন্য বিভিন্ন হামদ, নাত ও আহলে বাইতের সম্মানে গাঁথা বিভিন্ন কবিতাসমূহ কাওয়ালি ঢঙে তাকে গেয়ে শুনান। বলা হয়, খশরুর এই অভূতপূর্ব কবিতা ও শ্রুতিমধুর পাঠ ব্যঞ্জনায় অভিভূত হয়ে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শরীর ও মন দুটোই ফুরফুরে হয়ে ওঠে। এবং এরই সাথে সঙ্গীতে প্রশংসা, স্ততির নতুন একটি ধারা সামনে আসে। যার ¯্রষ্ঠা খসরু। এসব ঠিকঠাকই চলছিলো কিন্তু ১৩১০ সালে অবস্থা এমন হলো যে খসরু নিয়মিতভাবে খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া থেকে আধ্যাত্মিকতার পাঠ নেয়া শুরু করেন। এদিকে আলাউদ্দিন খিলজীর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অধিষ্ঠিত চাটুকারদের ভ-ামির কথা উল্লেখ ও রাজসীক নানা বিষয় উল্লেখ করে আমির খসরু ১৩১১ সালে ‘‘খাজায়েনুল ফাতাহ’’ রচনা করেন। এতে সাধারণভাবেই খসরুর তীর্যকতা ও কঠিন সমালোচনার দৃষ্টিপাত আলাউদ্দিন খিলজীর অপছন্দ হয়। এবং কিছুদিনের মধ্যে খসরুও সেসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে যারা খিলজীর এসব কার্জকলাপকে অপছন্দ করতেন। ফলে খসরু তার বিরাগভাজন হয়ে পড়ে। এদিকে ১৩১৪ সালে আলাউদ্দিন খিলজী কঠিন অসুখে পতিত হলে তার ঘরের লোকেরাও তাকে সুস্থ দেখতে চাচ্ছিলো না। এভাবেই একদিন অসুস্থতার ভেতরই সে মারা যায়। ইতিমধ্যে ক্ষমতার রশি টানাটানিও অব্যাহত ছিলো এবং এক’দুজন দূর্বল শাসকরাও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এসময় আঠারো বছর বয়সী সুলতান কুতুবউদ্দিন মোবারক খিলজী ক্ষমতায় বিরাজমান হলেন। ১৩১৬ সালে ক্ষমতায় আসা আয়েশী জীবন যাপনে অভ্যস্থ ও নারীসঙ্গ প্রার্থী কুতুবউদ্দিন খিলজীর কবিতার প্রতি ছিলো কঠিন ঝোঁক। ভীষণ আগ্রহ। সে খসরুকে রাজ প্রাসাদের নিকটে নিয়ে আসার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। এখানে থাকাকালীন সময়ে খসরু ‘‘দিওয়ানে বাকিয়্যা নাকিয়্যার’’ সংকলন করেন। পরে ১৩১৮ সালে বাদশাহ খসরুকে কবিতা লেখার আদেশ করলে খশরুর সর্বশেষ প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘‘না সেপহার’’ প্রকাশিত হয়।

খসরুর হিন্দী গীত তো তারই অমর সৃষ্টির উদহারণ। শতাব্দির পর শতাব্দি, কালের পর কাল ধরে তা নানা ভাবে গাওয়া হয়েছে। যেমন, আম্মা মেরে বাবা কো ভিজো জি…কে সাওন আয়া। …বেটি তেরি বাবা তো বুড়হি রে..কে সাওন আয়া। আম্মা মেরি ভাইয়া কো ভেঝো জি….কে সাওন আয়া…বেটি তেরা ভাইয়া তো বালারি…..কে সাওন আয়া…..জো পিয়া আওন কাহ গায়ি…

ইতিহাস বলে এই কবিতা পড়েই বাদশাহর রাজ্য বিজয়ের স্বাদ জাগে। এরপর ১৩১৯ সালে আমির খসরুর ‘‘মালফুজাতে নিজামুদ্দিনের’’ সংকলন ও বিন্যস্ত কাজ ও শেষ হয়। এদিকে কুতুবউদ্দিন খিলজীর উন্নাসিক জীবন যাপন ও অশৃঙ্খলায় তার প্রতি বিরূপ মনোভাবে প্রায় প্রতিদিনই তিনি খাজা নিজামুদ্দিনের দরবারে আসতে লাগলেন। একসময় কুতুবউদ্দিন দরবার থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খসরুর অনুপস্থিতির বিষয়টা টের পেলে বেশ ক’বার তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেসও করেন। অবশেষে ১৩২০ সালে সুলতান কুতুবউদ্দিন খিলজি তার অযাচিত আচরণের কারণে এক দাসের হাতে নিহত হন। তারপর সবকিছু ছেড়ে খসরুর হৃদয় কেবল খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবারে সঙ্গীতের ভেতর ডুবে গেল। দিন রাত সে তার দরবারেই পড়ে থাকে। এবং একদিন সুযোগ পেলে তৎকালীন প্রচলিত রাজকীয় এক লক্ষ মোহরে তার আধ্যাত্মিক মুর্শিদ ও গুরু খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়ার জুতো খরিদ করেন। এভাবেই আত্মার প্রশান্তি একান্ত হৃদ অনুভ’তি নিয়ে কাটানো দিনে ১৩২৫ সালে খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া রহ. পরলোকগমন করেন। আপন মুর্শিদের ইন্তেকালে খসরু প্রবলভাবে মনোপীড়ায় পড়েন এবং তার জীবন যেন ধূসরে পরিণত হয়। সে উদাসীন হয়ে পড়ে । খাজাকে ছাড়া তার নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হতে লাগে এবং এই বিরহবোধ নিয়ে কয়েক মাস পর সে বছরই আমির খসরু ইন্তেকাল করেন।

খসরুর হিন্দী গীত তো তারই অমর সৃষ্টির উদহারণ। শতাব্দির পর শতাব্দি, কালের পর কাল ধরে তা নানা ভাবে গাওয়া হয়েছে। যেমন, আম্মা মেরে বাবা কো ভিজো জি…কে সাওন আয়া। …বেটি তেরি বাবা তো বুড়হি রে..কে সাওন আয়া। আম্মা মেরি ভাইয়া কো ভেঝো জি….কে সাওন আয়া…বেটি তেরা ভাইয়া তো বালারি…..কে সাওন আয়া…..জো পিয়া আওন কাহ গায়ি.,….আজহো না আয়ে….সোয়ামি হো..আয় জো পিয়া অন কাহো গিয়ে। আয়ে না বারা মাস।….এ জো পিয়া আন কাহো গিয়ে। …..কাহে কো বিয়াহি বেদিস। রায়ে আখিয়া বাবল মোরে…।

খশরুর বচন ও শ্লোক খুবই প্রসিদ্ধ ছিলো। এখানে যেমন কয়েকটি উল্লেখ করা হলো- ফার্সি বোলি আয়ি না, তুর্কি বোলি পায়ি না। হিন্দি বোলো আরাছ আদে, কাহে খসরু কোয়ি বাতলা দে। ….মধ্যে আয়েনার নাম ফার্সি। যেটিকে তুর্কি ও হিন্দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্ত পাঠকের যেন এই মিশ্রন কোনভাবেই অনুভ’ত হতো না। -এক থাল থা মোতিয়ো সে ভরা ,…সব কে সার পার আউন্ধা ধরা ..চারো আউর ওহ থালি ফেরে..মুতি উস সে এক না গিরে-( আসমান)। রাত সামে এক ছোহা আয়া…ফুলো পাতো সব কো বাহায়া…আগে দে ওহ হোয়ে রুখ….পানি দে ওহ যায়ে ছুখ-( আতশ বাজি কা আনার) । এক গানওি নে ইয়ে গান কেনা…হারিল পিঞ্জিরে মে দে দেনা… দেখো জাদুগার কা হাল… ডালে হারা নিকালা হাল-(পান)।

খাজা আলতাফ হোসেন আলি ‘‘ইয়াদগারে গালিবের’’ সমাপ্তি যে পাঁচটি লাইনে করেছেন। সেখানে ওই তিন মহান ব্যক্তির বৈশিষ্টের কথা এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘‘এই সমস্ত বিষয়াদির উপর গভীর দৃষ্টিপাত করে মির্জা গালিবের ব্যাপারে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সাহিত্যিক যোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে সব্যসাচি আমির খসরু ও ফয়জির পর মির্জা গালিবের মত ভারতের মাটিতে আজ পর্যন্ত কেউ জন্মেছে! এবং এখন যেহেতু সময়ও পাল্টে গেছে তাই ভবিষ্যতেও এ আশা করতে পারি না, প্রাচীন ধারার কাব্য সৃষ্টিতে এমন কেউ জন্মাবে।’’

 

 

আপনি আরও পড়তে পারেন