সিনেমা হলগুলোতে হিজড়া-পতিতাদের দৌরাত্ম্য

দর্শকদের হলবিমুখ হবার অনেক কারণ রয়েছে। তবে সব আলোচনাতেই উঠে আসে বর্তমান সময়ের হলগুলোর পরিবেশের কথা। নানা অযত্ন-অবহেলা আর অসচেতনতার কারণে সিনেমা হলগুলোর নোংরা এবং মন্দ পরিবেশ রুচিশীল দর্শকদের বিরক্ত করে তুলেছে। দিনে দিনে সেই বিরক্তি ক্ষোভে পরিণত হয়ে হলবিমুখ হয়েছেন তারা।

অথচ এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই হল মালিক ও চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিদের। সম্প্রতি রাজধানীর বেশ কিছু সিনেমা হল ঘুরে দেখা গেল বেদনাদায়ক দৃশ্য। প্রায় সব ক’টি হলের সামনেই রাজত্ব কায়েম করেছে দেহ ব্যবসায়ী ও হিজড়ারা। তাদের অশালীন ইঙ্গিত, বিব্রতকর মন্তব্য, টিকিট জালিয়াতি ও ব্ল্যাকিংয়ের কারণে হলগুলোতে দর্শক আসা কমে গেছে। এমনকি গেল রোজার ঈদে চলচ্চিত্রের রমরমা বাণিজ্যের মধ্যেও এই উৎপাত ছিলো বিরাজমান।

মিরপুরের সনি, ফার্মগেটের আনন্দ এবং ছন্দ সিনেমা, কারওয়ানবাজারের পূর্ণিমা ও কাকরাইলের রাজমনি, পুরান ঢাকার আজাদ সিনেমা হলে পতিতা এবং হিজড়ারা প্রকাশ্যেই দর্শকদের সঙ্গে নানা অসামাজিক ইঙ্গিত ও দৃষ্টিকটু আচরণ করছে। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলোর স্বাভাবিক পরিবেশ।

রাজধানীর সিনেমা হলগুলোতে পতিতা এবং হিজড়াদের অবাধ আনাগোনার কারণে অনেকেই সিনেমা দেখতে বিব্রতবোধ করছেন- এমন অভিযোগ করেছেন হলে সিনেমা দেখতে আসা দর্শকরা। গত শনিবার আনন্দ সিনেমা হলে জিৎ-নুসরাতের ‘বাদশা’ ছবি দেখতে আসেন পশ্চিম রাজাবাজারের বাসিন্দা দুই বন্ধু অপু ও রাহাত। তারা জানান, দিন দিন এখানে পতিতাদের আড্ডা বাড়ছেই। হঠাৎ করে পুলিশ এসে অভিযান চালালে দু-একদিন ওদের আনাগোনা বন্ধ থাকে। কিন্তু আবার তারা হল দখল নেয়। এদের জন্য নারী নিয়ে হলে আসা যায় না। কাছে এসে এরা নানা রকম কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে।

রাহাত বলেন, ‘দিনের বেলায় উৎপাত কম থাকে। তাই এসেছি। সন্ধ্যা হলেই পতিতারা লাইন ধরে আনন্দ ও ছন্দ সিনেমা হলের সামনে দাঁড়ায়। তখন সিনেমা হলের সামনের ফুটপাত দিয়েও হাঁটাচলা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। অথচ চরম ব্যস্ত এলাকা ফার্মগেটের এই জায়গাটি। পাশাপাশি প্রতিদিন হাজার হাজার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আনাগোনা এখানে। সবাই বিব্রত হয়।’

ছন্দ হলের সামনে ফুটপাতের এক ফল বিক্রেতা বললেন, ‘সন্ধ্যা হলে এখানে পতিতাদের বাজার বসে। নানা এলাকা থেকে লোক এসে পতিতা ভাড়া করে নিয়ে যায়। এই হল দুটি বিনোদনের বদলে পতিতাদের স্টেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সবগুলো হল নিয়েই এই রকম অভিযোগ দর্শক, পথচারী ও স্থানীয়দের। অথচ হল কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। জানা যায়, প্রতিদিন একেকজন পতিতা ২০০-৩০০ টাকা করে হল কর্তৃপক্ষকে কমিশন দিয়ে প্রকাশ্যেই অসামাজিক কার্যক্রম চালায়। ফলে সিনেমা হলের কর্মকর্তারা সব দেখেও না দেখার ভান করেন।

তবে পতিতাদের নিয়ে অসামাজিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি পূর্ণিমা সিনেমা হল থেকে কামাল নামে একজনের চাকরি গেছে বলে জানা গেছে। কুদ্দুস আলি নামের এক দর্শক বলেন, ‘বোরকা পরিহিত কিছু মহিলা হলের ভিতর এমন অসামাজিক কার্যকলাপ করেন, যা আসলে মুখে বলার মত নয়।’

দীপক নন্দি বাদল নামে এক দর্শককে দেখা গেল বোরকা পরিহিত নারী নিয়ে হলে ঢুকছেন। সন্দেহ হলে তার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে জানা গেল, তিনি ২৫০ টাকা চুক্তিতে এক পতিতাকে নিয়ে যাচ্ছেন। এর আগেও বেশ কয়েকবার পূর্ণিমা হলে তিনি এভাবে ছবি দেখেছেন।’ তার ভাষায়, ‘হলের সবার সামনে এসব বেটি লইয়া ঢুইকা অনেকেই অনেক কিছু করে। কেউ কিছু কয় না।’

একই চিত্র দেখা গেল ঢাকার জজকোর্টের পাশে অবস্থিত জনপ্রিয় সিনেমা হল আজাদে। সেখানের এক দর্শক বললেন, ‘কিছু টাকা-পয়সা দিলে হলের লোকরা মেয়ে নিয়ে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়। অনেকেই এখানে প্রেমিকা নিয়েও চলে আসেন। হলের কর্মচারীরা টাকার বিনিময়ে অনেক সুবিধা দেয়।’

অয়ন নামে এক দর্শক বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। মাঝে মধ্যেই ছবি দেখতে হলে আসি। ছোটবেলা থেকেই বাংলা ছবির পোকা আমি। পরিবেশ নিয়ে প্রতিবারই নানা রকম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবুও অল্প দামে টিকিট পাওয়া যায় বলে এখানে আসি। কারণ, সিনেপ্লেক্সগুলোতে টিকিটের অনেক দাম। এত টাকা দিয়ে প্রতি সপ্তাহে আমাদের মতো মেসে বসবাস করা ছাত্রদের পক্ষে ছবি দেখা সম্ভব নয়। একজন নাগরিক হিসেবে সুস্থ পরিবেশে বিনোদন উপভোগের অধিকার আমার আছে। তাই আমি চাইব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন এই বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেন। নইলে ‘সিনেমা হল’ শব্দটি কিছুদিন পর জাদুঘরে পাঠাতে হবে।’

সিনেমা হল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন একটি সিনেমা হলে কমপক্ষে তিনবার করে সিনেমা প্রদর্শন করা হয়। এসময় হলগুলোর সামনে কাকলি,  মরিয়ম,  সালমা,  মুন্নি,  সুফিয়া, জেসমিনসহ অনেকেই বোরকা পরিহিত অবস্থায় ঘোরাঘুরি করতে থাকে আর আগত দর্শকদের চোখে ইশারা করে। তারপর একজন খদ্দেরের সাথে একটি ছবি দেখার বিনিময়ে ২০০-৩০০ টাকা চুক্তি করে হলে প্রবেশ করে এবং অন্ধকারে বসে জড়াজড়িসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ করে। শুধু তাই নয়, খদ্দেরদের ব্ল্যাকমেইল করে সর্বস্বান্ত করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

এদিকে রাজমনি সিনেমা হলে ১০-১৫ জনের একটি হিজড়া গ্রুপ অসামাজিক কার্যকলাপ করে আসছে বলে অভিযোগ করেছেন হলটির নিয়মিত বেশ ক’জন দর্শক। কাকরাইল মোড়ে অবস্থিত আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সামনে থেকে এসব হিজড়ারা খদ্দেরের সাথে চুক্তি করে রাজমনি হলে এসে অসামাজিক কার্যকলাপ করে। প্রায় সময়ই এসব হিজড়া খদ্দেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সব রেখে দেয়।
indexg
রাজমনি সিনেমা হলের সামনে এক মুড়ি বিক্রেতা জানান, ‘হিজড়া এবং রাস্তার কিছু উদ্বাস্তু মেয়েদের প্রায় সময়ই হলে প্রবেশ করতে দেখেছি এবং শুনেছি তারা অসামাজিক কার্যকলাপ করে। শিক্ষিত পরিবারের ছেলেরাও এদের খদ্দের হিসেবে আসে।’

এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে রাজমনি সিনেমা হলের ম্যানেজার মো. অহিদুল রহমান বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘হিজড়ারা এখানে প্রস্রাব পায়খানা করতে আসে। এখানে অসামাজিক কোনো কাজ হয় না। পূর্ণিমা সিনেমা হলে হয় বলে শুনেছি।’

বিষয়টি স্বীকার করে পূর্ণিমা সিনেমা হলের ম্যানেজার মো. আমির হোসেন বলেন, ‘আমার সামনে কোনো অসামাজিক কাজ হয় না। তবে আমার অগোচরে বিচ্ছিন্নভাবে এসব হয়ে থাকে বলে আমিও শুনেছি। তাই আমরা কঠোর দৃষ্টি রাখছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘মাঝে হলে দর্শক আসতো না। ব্যবসা ছিলো না। তাই মালিকরা হল নিয়ে উদাসীন ছিলেন। তবে গেল ঈদে ছবির ব্যবসা দেখে আশাবাদী হয়েছেন তারা। পূর্ণিমা হলকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হচ্ছে। আশা করি আর কোনো অভিযোগ থাকবে না আমাদের হল নিয়ে। সেই সাথে রাজধানীর সব হলেই ইতিবাচক পরিবেশ ফিরে আসবে শিগগিরই।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment