সাভারে ছিনতাই চক্রের মূল ঘাটি, জড়িত ২ স্বর্ণ ব্যবসায়ী অভিযোগ-টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ!

সাভারে ছিনতাই চক্রের মূল ঘাটি, জড়িত ২ স্বর্ণ ব্যবসায়ী অভিযোগ-টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ!

নোমান মাহমুদঃ ২৫শে ডিসেম্বর সোমবার, দুপুর প্রায় ১.০০ টা। সাভারের থানা ষ্টান্ড সংলগ্ন মডার্ন প্লাজার সামনে থেকে মধ্যবয়সী এক নারীর ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় হাতেনাতে শুভ (২৬) নামে এক ছিনতাইকারী যুবককে আটক করে উপস্থিত স্থানীয় জনতা। কিন্তু ততক্ষনে ব্যাগ উধাও ! জানা গেলো জনতার হাতে আটককৃত ঐ যুবক একা নয়, তার সাথে ছিলো আরও ৩ জন। দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার, নগদ ৫ হাজার টাকা ও একটি সিম্ফোনি মোবাইল সহ খোয়া যাওয়া ব্যাগটি তাদের দখলেই।
সাভারে ছিনতাই চক্রের মূল ঘাটি, জড়িত ২ স্বর্ণ ব্যবসায়ী অভিযোগ-টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ!ব্যাগ না পেয়ে উত্তেজিত জনতা আটক ঐ যুবককে উত্তম-মাধ্যম দেওয়া শুরু করতেই যুবকটি শর্ত জুড়ে দেয়, ব্যাগ সে ফিরিয়ে দিবে, বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। এই ঘটনার বেশ কিছুক্ষন পর কৌশলে ছিনতাই চক্রের অন্য সদস্যরা ব্যাগটি সত্যিই ফিরিয়ে দিয়েছিলো। আর এই সময়টুকুর ব্যবধানে জনতার হাতে আটক যুবক প্রকাশ করে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। কে সে, কারা কারা এই চক্রের সাথে জড়িত, কোথায় এই চক্রের মূল ঘাটি, তাদের অপরাধের এলাকা, ছিনতাইয়ের কৌশল, চক্রের সদস্য সংখ্যা, চক্রের মূল হোতাসহ আরও অনেক কিছু। জনতার হাতে আটক এই ছিনতাকারী যুবকের নাম শুভ ঘোষ (২৬)। সে মানিকগঞ্জ জেলার, ঘিওর থানার কুলহারা গ্রামের মিষ্টি ব্যবসায়ী ধীরেন চন্দ্র ঘোষের ছেলে। বর্তমানে সাভারের আমিনবাজার বড়দেশি এলাকার হোসেন মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া। তার মত আরও ১০ জন সক্রিয় ছিনতাইকারী সদস্য আছে তাদের এই চক্রে। তাদের মধ্যে নজরূল এর অবস্থান (৪৫) বড়দেশি (চুনাপাড়া) আমিনবাজার এলাকায়, গৌতম (৩৫) সাভারের বলিয়ারপুর এলাকায়, বরকত (৩৫) সাভারের জোরপুল এলাকায়, মাসুদ (২৬) সাভারের হেমায়েতপুর জয়নাবাড়ি এলাকায়, সুব্রত (২৫) আমিনবাজার ও মইন (২২) এর অবস্থান চক্রের মূল হোতার বাড়ি। বাকীদের নাম জানা যায়নি। আর এই পুরো চক্রটি নিয়ন্ত্রন করছে আশিক (৩৫) নামের এক ব্যক্তি। সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের ভাকুর্তা প্রাইমারী স্কুলের পাশেই চক্রের মূল হোতার বাড়ি। সেখান থেকেই চক্রের সদস্যরা কে কোথায় ছিনতাইয়ের দায়িত্ব পালন করবে, কোন গ্রুপে কে কে থাকবে তা নির্ধারন করে দেওয়া হয়। শুভ নামের ছিনতাইকারী চক্রের ঐ সদস্য আরও জানায় কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে সাভারের নবিনগর এলাকা পর্যন্ত তারা ছিনতাই করে থাকে। গত কয়েকদিন পূর্বে শ্যামলী চক্ষু হাসপাতালের সামনে এক নারীর কাছ থেকে নগদ ১ লক্ষ টাকা সহ একটি ব্যাগ ছিনতাই, কল্যানপুর ব্রিজের নিচ থেকে ব্যংক থেকে টাকা উত্তোলন করে ফেরার পথে ৫০ হাজার টাকার ব্যাগ ছিনতাই, ২০/২৫ দিন পূর্বে সাভার নিউ মার্কেটের সামনে থেকে ২ ভরি স্বর্ণালংকার সহ একজন নারীর ব্যাগ ছিনতাই এই প্রত্যেকটি ঘটনাই এই চক্রের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে শ্যমলী থেকে নগদ ১ লক্ষ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্ব্য দেয় খোদ এই চক্রের দলনেতা আশিক। তাছাড়া সে আরও জানায়, চক্রের দ্বারা ছিনতাইকৃত যাবতীয় মালামাল সর্ব প্রথম জমা দেওয়া হয় তাদের ওস্তাদ, চক্রের মূল হোতা আশিকের কাছে। এরপর আশিক তা বিভিন্ন স্থানে বিক্রয় করে অর্থ সংগ্রহ করে সবার মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে। ছিনতাইকৃত মালামালের সকল ক্রেতাদের নাম জানা না গেলেও, জানা যায় ছিনতাইকৃত স্বর্ণ কিনে নেয় মোঃ কুদরত আলী ও মোঃ কাজল নামে দুই স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ী। রাজধানীর মিরপুর এলাকার বড়বাজারে তাদের অনিক জুয়েলার্স ওয়ার্কশপ নামে একটি স্বর্ণালঙ্কারের দোকান রয়েছে (দোকান নং-৫৫)। এইসব এলাকার চুরি, ছিনতাই, ডাকাতীর যাবতীয় স্বর্ণ কিনে নেয় তারা। বিনিময়ে প্রতি ভরি স্বর্ণে বাজার মূল্য হতে ১০ হাজার টাকা কম দাম দেওয়া হয়। তাছাড়া চক্রের এই সদস্য আরও জানায়, তাদের মূল টার্গেট নারীরা। দিনের আলোয় তারা বিভিন্ন বাহানায় নারীদের দাড় করিয়ে কথা বলতে থাকে, আর এই ফাকে চক্রের অন্য সদস্যরা টার্গেটের হাতে থাকা ব্যাগ নিয়ে চম্পট দেয়। চম্পট দেওয়া যুবকের পিছনে ভুক্তভোগীর ছোটার ফাকে চম্পট দেয় তার সাথে কথা বলা প্রথম যুবক। আর রাতের আধারে চক্রের সদস্যরা রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয় টার্গেটের। চক্রের এই সদস্য আরও জানায়, এই ১১ সদস্য বিশিষ্ট ছিনতাই চক্র ছাড়াও আরও একটি মলম চক্র আছে তাদের ওস্তাদ দলনেতা আশিকের। সেই চক্রে রয়েছে ১৪ জন সক্রিয় সদস্য। তবে তার দাবী এক চক্রের সাথে অপর চক্রের সদস্যদের কোন যোগাযোগ নেই। দুটো চক্রই আশিকের নিয়ন্ত্রনে। দিনে দুপুরে এমন অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটনের পরও কি তারা ধরা পরেনা এমন প্রশ্নের জবাবে চক্রের এই সদস্য জানায়, সাধারনত জনতার হাতে খুব কমই তারা ধরা পরে। আর পুলিশের কাছে ধরা পরলে তাদের ব্যবসায় লোকসান হলেও তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে। কেননা ছিনতাইয়ের ঘটনায় কোন ভুক্তভোগীই সাধারনত মামলা করতে যায়না, আর পুলিশকে টাকা দিলে, সুযোগ বুঝে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। উদাহরণ হিসাবে সে বলে, গত ১ মাস আগেও তাদের ওস্তাদকে মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে থেকে ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে আটক করে দারুস সালাম থানা পুলিশ। সেদিন রাতেই নগদ ২০ হাজার টাকা দিলে থানা হাজত থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এমন অসংখ্য ঘটনার অভিজ্ঞতা রয়েছে ছিনতাই চক্রের সদস্যদের। জানা যায়, এই দুই অপরাধী চক্র ছাড়াও আরও ৫/৬ টি অপরাধী চক্র সক্রিয় এইসব এলাকায়। আর অধিকাংশ চক্রের মূল ঘাটিই সাভার-আশুলিয়ায়। সাভারের আমিনবাজার, ভাকুর্তা, বলিয়ারপুর, হেমায়েতপুরের জয়নাবাড়ি, বনগ্রাম, আশুলিয়ার গাজিরচট, নরসিংহপুর সহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে তারা তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। তাছাড়া এই দুই অপরাধী চক্রের মূল হোতা আশিক ছিনতাইয়ের টাকায় ইতিমধ্যে সাভারের ভাকুর্তায় ৩ টি জমি ক্রয় একটি বাড়ি নির্মান করেছে বলে জানা যায়। রয়েছে ২টি প্রাইভেট কারও। যার একটি সে নিজে ব্যবহার করে আর অন্যটি রেন্ট-এ-কারে ভাড়ায় চলে।  প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললে হরহামেশাই চোখে পড়ে ছিনতাইকারী, মলম পার্টির খপ্পরে পরে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হওয়া মানুষের আহাজারী। বিভিন্ন সময় এসকল ঘটনায় প্রান হাড়িয়েছেনও অনেকে। পরিবার হারায় তাদের স্বজনদের। কিন্তু এত কিছুর পরও থেমে নেই অপরাধীদের দৌরাত্ম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ব্যার্থ এসব অপরাধীদের নির্মূলে। মাঝে-মধ্যে ২/১টি চক্র ধরা পড়লেও অধিকাংশই থাকে ধরাছোয়ার বাহিরে। আর শুভ নামের অপরাধী চক্রের সক্রিয় এই সদস্যের বক্তব্য অনুযায়ী ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের দলনেতাকে থানা হাজত থেকে মুক্তি দেওয়ার ঘটনা যদি সত্য হয় তবে সর্বস্ব হাড়ানো, প্রান হাড়ানো মানুষগুলোর জন্য এর চেয়ে বেশি দূর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। যার দায় নিতে হবে সেইসব অভিযুক্ত অসাধু পুলিশ সদস্যকেই। বর্তমান প্রেক্ষাপট বলছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এইসব অপরাধী চক্রগুলোকে শক্ত হাতে দমন না করলে দিনের পর দিন শুধুই ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে দেশের সর্বস্ব হাড়ানো মানুষগুলোর আহাজারী, ছিনতাইকারীদের হাতে প্রান হাড়াতে হবে আরও অনেককে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment