দিনাজপুরে ৫ প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বিপাকে মোজাম্মেল

দিনাজপুরে ৫ প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বিপাকে মোজাম্মেল

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে ৫ প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে মোজাম্মেল হকের পরিবার। চরম দুঃখ কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার ৪নং আটগাঁও ইউনিয়নের লোহাগাঁও গ্রামের মৃত এমারউদ্দীনের ছেলে মোজাম্মেল হক ওরফে বুধু’র পরিবারে এ ৫ প্রতিবন্ধী ছেলের জন্ম।
দিনাজপুরে ৫ প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বিপাকে মোজাম্মেল
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মোজাম্মেল হক ওরফে বুধু ১৯৯৬ সালে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার বলরামপুর গ্রামে আবেদ আলীর মেয়ে বিউটি আরা খাতুনকে বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পর তাদের ঘরে এক এক করে ৬টি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। একমাত্র তৃতীয় ছেলে রিয়াদ (১৪) ছাড়া বাকি ৫টি ছেলে সন্তানই শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধীরা হলো, সবচেয়ে বড় ছেলে বিপ্লব (১৮), মিরাজ ওরফে রাসেল (১৫), রাজু (৯), রিশাত (৭) ও জীবন (৪)।

একই পরিবারের ৫টি সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্ম নেওয়ায় গ্রামের কিছু কুসংস্কার মনের মানুষ ভালো চোখে দেখছে না তাদের। সমাজে অন্যদের সঙ্গে তারা ভালোভাবে খোলা-ধুলা, মেলামেশা এবং চলাফেরা করতে পারে না। অধিকাংশই সময় বাড়ীতেই থেকে সময় কাটাতে হয় তাদের। প্রতিবন্ধী হওয়ায় পিতা মাতাকেই দেখা শুনা করতে হয় তাদের।

এদিকে সংসারের ৮ জন মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে অসহায় পিতা মোজাম্মেল হক বুধুকে কাজ করতে হয় চায়ের দোকানে। প্রতিদিনি দিন হাজিরা ২’শত টাকা দিয়ে তার সংসার চালাতে হয়। মাত্র ২’শত টাকা দিয়ে ৮ জন মানুষকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত দেয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে মোজাম্মেলের। চাষাবাদের জন্য বিঘে খানিক জমি বর্গা চুক্তি নিয়ে চাষও করেন তিনি। জীর্ণশীর্ণ একমাত্র কুড়ে ঘড়ে একত্রে স্বামী স্ত্রী ও ৬ সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন তারা।

একই পরিবারের ৫ জন প্রতিবন্ধী মানুষ থাকার পরও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিমুখ আচরণে দীর্ঘদিন ধরে সরকার থেকে কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি তারা। অবশেষে বোচাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ফরহাদ হাসান চৌধুরী ইগলুর প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে মিরজা ওরফে রাসেল মাসিক ৫’শত টাকা ও ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে বিপ্লব মাসিক ৬’শত টাকা করে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে উপজেলা সমাজসেবা অধিদফতর থেকে। যা থেকে কিছুটা হলেও অভাব লাঘব হয়েছে তাদের।

প্রতিবন্ধীদের মা বিউটি খাতুন জানান, একটি স্বাভাবিক সন্তান মানুষ করতেও খুব কষ্ট করতে হয় কিন্তু পরপর ৫টি প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে যে কি অমানুষিক কষ্ট-দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা কেউ অনুভব করে না! আমার প্রতিবন্ধী ৫ সন্তান যে কি শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাদের সাথে কেউ মিশতে চায় না। খেলা-ধুলা করে না। বাড়ির বাইরে গেলে অন্যরা তাদের দেখে বিরূপ মন্তব্য করে। কিন্তু প্রতিবন্ধী হলেও তাদেরকে বোঝা হিসেবে না নিয়ে অন্যান্য স্বাভাবিক সন্তানের মতই মানুষ করতে হচ্ছে তাদের।

তিনি জানান, সমাজের কিছু মানুষ নানা রকম কটূক্তি করে। তাদের কটূক্তি সহ্য করেই শত দুঃখ কষ্টের মাঝে দিন পার করতে হচ্ছে আমাদের। প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্ম নিলেও প্রতিটি সন্তানকেই মায়ের মমতা দিয়ে ভালোবাসি আমি। তাদের লেখাপড়া জন্য ভর্তি করে দিয়েছি হাট মাধবপুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুলে। সপ্তাহে ৫দিন স্কুলের অটোতে করেই নিজেই ৫ সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাই ও নিয়ে আসি। তারা এখন স্কুলে যেতে পেরে খুব খুশি। স্কুলে খেলার সাথী ও শিক্ষকদের সাথে মিশতে পেরে তারা এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। প্রতিদিন বাড়ীতেও পড়াতে বসাই তাদের। বাবা-মা’র ইচ্ছা যতটুকু সম্ভব লেখাপড়া করে তারা যেন সমাজের বোঝা না হয়ে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারে। বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের সমাজে বোঝা নয় সম্পদ হিসেবে দেখার কারণে এই পরিবারটির মনে আশা জেগেছে তাদের বাকি তিনটি সন্তানরই প্রতিবন্ধী ভাতা পাবেন।

লোহাগাঁও গ্রামের বিশিষ্ট সমাজ সেবক মিজানুর রশিদ জানান, বর্তমান সরকার যেভাবে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে এগিয়ে এসেছে, তাতে আমরা আশাবাদী এই পরিবারটির দীর্ঘদিনের অভাব অনটন দূর হবে। শুধু সরকার নয়, সমাজের বিত্তবান মানুষদের এই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ৪নং আটগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কফিল উদ্দীন জানান, আমরা এই অসহায় পরিবারটির পাশে আছি এবং থাকবো। এদের জন্য যা করার দরকার আমাদের পরিষদ তা করবে।

বোচাগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আহসান হাবিব জানান, একই পরিবারের ৫জন প্রতিবন্ধী একটি ব্যতিক্রম বিষয়। ইতোমধ্যে সমাজসেবা অধিদফতর বোচাগঞ্জ অফিস থেকে দুইজনের ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাকি তিন জনকেও ভাতার আওতায় আনা হবে। ‘মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনে জন্য’ এই উক্তিটি যদি কোনো সুহৃদয়বান ব্যক্তি যদি মনে করে থাকেন তাহলে সামজের অবহেলিত এই অসহায় প্রতিবন্ধীদের পাশে এসে দাঁড়াবেন এটাই কাম্য প্রতিবন্ধী পরিবার ও সচেতন মহলের।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment