বস্তিতে কেন আগুন

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি জায়গায় গড়ে তোলা বস্তিতে প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকা-। কেবল একটি-দুটি নয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে আগুনে পুড়েছে ২৪টি বস্তি। সহায়সম্বলের সঙ্গে সেই আগুন কেড়ে নিয়েছে ১৪ হতদরিদ্রের প্রাণ। সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে হাজারো নিম্নবিত্ত পরিবার।

গত এক বছরে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতেই তিনবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটল। গেল বছর ১৪ মার্চ পুড়ে যায় অর্ধশত ঘর, ৪ ডিসেম্বরের আগুনে ছাই হয় পাঁচ শতাধিক ঘর, সব শেষ গত ১৫ মার্চ রাতেও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। তবে এ বস্তিতে বারবার আগুন লাগার কারণ সবারই অজানা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, গেল বছর সারাদেশে ১৬৫টি বস্তিতে আগুন লাগে। এর মধ্যে রংপুরে ৮৮টি, চট্টগ্রামে ৪৩টি, ঢাকায় ৩৩টি ও সিলেট বিভাগে একটিতে। অর্থাৎ গড় হিসাবে তিন দিন অন্তর দেশের কোথাও না কোথাও বস্তি পুড়ছে।

এসব ঘটনায় সহায়সম্বল হারিয়েছে লাখো মানুষ। অর্থের বিচারে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৩ কোটি ৬১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৫০ টাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, সরকারি জায়গা দখল নিতে দুর্বৃত্তরাই বস্তিতে আগুন লাগায়। যদিও প্রতিটি ঘটনার পরই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি; কিন্তু তদন্তে বস্তিবাসীর অভিযোগের (নাশকতা) সত্যতা পায় না তদন্তসংশ্লিষ্টরা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছেÑ বস্তিতে কেন বারবার আগুন লাগে? এগুলো দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা? ফায়ার সার্ভিস ও বস্তিবিষয়ক গবেষকরা অবশ্য বলছেনÑ অবৈধভাবে টানা গ্যাস-বিদ্যুতের অনিরাপদ ব্যবহার, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও অসতর্কতাসহ বিভিন্ন কারণে বস্তিতে অগ্নিকা- বেশি ঘটছে। অধিকাংশ ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের লাইন থেকে।

একটু সচেতনতা আর গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বস্তির অগ্নিকা- কমাতে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। আবার দখলের জন্য আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। তবে শক্ত প্রমাণের অভাবে বস্তিবাসীর সেই অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে তদন্তসংশ্লিষ্টদের কাছে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় সব হারিয়ে বরিশালের ভোলা থেকে ঢাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন অসংখ্য বানভাসি মানুষ।

সালাম সিকদারের (মৃত) নেতৃত্বে তখন কল্যাণপুরের নতুনবাজার এলাকায় ছোট্ট পরিসরে খালপাড়ের একটি স্থানের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করে পাঁচ থেকে ছয়শ ছিন্নমূল পরিবার। শুরু হয় নতুন করে স্বপ্ন দেখা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তা পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। ১৯৮৯ সালের ১৩ অক্টোবর রহস্যজনক আগুনে পুড়ে ছারখার সাজানো সেই বস্তি। পুড়ে অঙ্গার হয় নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ নয় জন। সেই থেকে বস্তিটির নাম ‘কল্যাণপুর পোড়াবস্তি’। কালের বিবর্তনে এখন সেখানে প্রায় ৫ হাজার পরিবারের বসবাস। পোড়া বস্তিবাসীর অভিযোগ, যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের দৃষ্টি পড়ে এ বস্তির ওপর। দখলের উদ্দেশ্যেই বেশিরভাগ আগুন দিয়েছে প্রভাবশালীরা।

১৯৮৯ সালে কমিশনার সিজুর নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত জ্বালিয়ে দিয়েছিল বস্তিটি। এর পর একে একে পাঁচবার আগুন লাগে, যার মধ্যে তিনটিই ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারি স্থানীয় প্রভাবশালীদের পোষ্য ‘লাল বাহিনী’ গানপাউডার দিয়ে প্রকাশ্যে আগুন দেয়। এর আগের দিন বস্তিটি উচ্ছেদ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় গণপূর্ত বিভাগ। ২০০৩ সালে একবার বস্তির দখল নিতে বিনানোটিশেই ভেঙে দেয় তৎকালীন কমিশনার শামীম পারভেজ। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কারণে তদন্তকাজ আজও পড়ে আছে মুখ থুবড়ে।

পোড়াবস্তির প্রবীণ বাসিন্দা এস্কান্দার আলী মোল্লা বলেন, ‘১৯৮৯ সালের অগ্নিকা-ের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তখন আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে এখানকার বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হবে না। সবাইকেই পুনর্বাসন করা হবে। অথচ এ সরকারের আমলেও আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করা হচ্ছে।’ এদিকে গত ৩ মার্চ উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যেই রহস্যজনক অগ্নিকা-ে বসতভিটা হারিয়েছেন কারওয়ানবাজার রেললাইন বস্তির তিন শতাধিক ঝুপরিঘরের বাসিন্দা। তাদের দাবিÑ উচ্ছেদ অভিযানের অংশ হিসেবেই পরিকল্পিত আগুনে তাদের ঘরছাড়া করা হয়েছে। এ ঘটনার চারদিন আগেই ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পুড়ে যায় ভাষানটেকের সিআরপি ও বিআরপির মাঝখানে সরকারি জায়গায় পানির ওপর গড়ে তোলা আবুল ও জাহাঙ্গীরের বস্তি। ঘটনায় তিন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুও হয়।

গৃহহীন হন খাদিজা, হাজেরা, সফুরা, দিদার, চম্পা, মল্লিকা, গিয়াস, শুক্কুর, চান বানু, করিম, তানিয়া, শিউলী, সজীব, আবুল, নাসরিন, নাহারের মতো পাঁচ শতাধিক পরিবার। বস্তিবাসীর দাবি, অগ্নিকা-ের কয়েক দিন আগে পাশের একটি বস্তিতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। তখন জাহাঙ্গীর বস্তিও উচ্ছেদের চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। দখল নিতেই তারা পরিকল্পিতভাবে পেট্রল-কেরোসিন ঢেলে এ বস্তিতে আগুন দিয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের নির্যাতনের ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভাষানটেক বস্তির বেশ কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের সময়কে বলেন, দুর্ঘটনায় অগ্নিকা- হলে আগুন লাগবে একটি ঘরে। ছড়াবে একদিক থেকে। কিন্তু সে রাতে একসঙ্গে আগুন লাগে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘরে। তারা আরও বলেন, ঘটনার প্রায় ১০ দিন আগে অপরিচিত কয়েকজন বস্তিতে এসে ঘোরাঘুরি করে। তাদের চলাফেরা ছিল সন্দেহজনক। যুবকরা বলছিলÑ বস্তি ভেঙে দেওয়া হবে। তারাই আগুন দিয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকায় ভেড়া মার্কেট বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুনে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যায় নয় জন। ওই আগুনও পরিকল্পিতভাবে লাগিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

গত বছর ১১ মার্চ ভোরে রাজধানীর পল্লবীর ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পুড়ে ছাই হয় প্রায় দুই হাজার ঘর। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, এটি দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা। তবে বর্তমান সাংসদ ইলিয়াস মোল্লার দাবিÑ এটা নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা। তদন্তের বরাত দিয়ে মিরপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন অফিসার মজিবর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘কল্যাণপুরের পোড়াবস্তি, ভাষানটেকের দুই বস্তি ও ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে যে অগ্নিকা-, সেগুলোতে এখন পর্যন্ত নাশকতার প্রমাণ মেলেনি। অগ্নিদুর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও চুলার আগুন থেকে।’ বনানীর কড়াইল বস্তিতে গত এক দশকে ১৭ বার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত তিন বছরে ছয়বার লাগা অগ্নিকা-ের তিনটিকেই নাশকতা বলে দাবি করেন ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী। বারবার আগুন লাগলেও বস্তিবাসীর মতো কারণ অজানা প্রশাসনের কাছেও। আবার যাদের চেষ্টায় আগুন নেভানো হয়, সেই ফায়ার সার্ভিসের কাছেও এ ব্যাপারে পরিষ্কার উত্তর মেলেনি। গত ৯ মার্চও কড়াইল (জামাই বাজার) বস্তিতে ভয়াবহ আগুন লাগে।

এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। তবে এর আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় হতদরিদ্রদের বেশ কয়েকটি ঘর। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে রাজধানীর তেওগাঁও রেললাইন সংলগ্ন নাখালপাড়ার বাবুলবাগ বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ছাই হয়ে গেছে ২০টি হতদরিদ্রের ঘর। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে শতাধিক কবুতর ও মুরগী। বিশ্বখ্যাত এনজিও ব্র্যাকের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বস্তিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করছেন বিজয় বাংলা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক এসএম মাহামুদুল হাসান। অগ্নিকা-ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগুন লাগা এবং লাগানোর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। কখনো জায়গা খালি করা, কখনো বস্তিতে নতুন দখলদারের ছড়ি ঘোরানো, কখনোবা বস্তির জায়গায় নতুন কোনো প্রকল্পÑ এমন অনেক মহাকূটপরিকল্পনা থাকে ঝুপড়ি ঘরগুলো ঘিরে। এতে ভূমি দখলের রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোই জড়িত থাকতে পারে।

আবার কড়াইলের বউবাজার ও জামাইবাজার এলাকার বস্তিতে বেশ কয়েকবার অগ্নিকা-ের পর স্থানীয়রা অভিযোগ তুলেছিলেন, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তিতে সেই অভিযোগের সত্যতা পায়নি তদন্তসংশ্লিষ্টরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মূলত অসচেতনতা, সিগারেটের আগুন, রান্নার পর চুলা বন্ধ না করা, পুরনো বৈদ্যুতিক তারে শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপ লিকেজ থেকে বেশিরভাগ আগুনের সূত্রপাত। এত বড় কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগলে তা নেভাতে পানিরও জোগান নেই। যেহেতু বস্তিতে অসংখ্য মানুষের বসবাস, তাই কড়াইলসহ এ ধরনের বড় বস্তিগুলোর কাছে সার্বক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসের অন্তত একটি ইউনিট, তিনটি ঘর অন্তর একটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, ফায়ার অ্যালার্ম, প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়ার তৈরি, পানির সঠিক জোগান রাখা জরুরি। সর্বোপরি মানুষের মাঝে সচেতনতা ফিরিয়ে আনা গেলে অগ্নিকা-ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশেই হ্রাস পাবে।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment