ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন অমর্ত্য সেন

ভারতকে প্রতিনিয়ত পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। দেশটির গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে সকারের কড়া সমালোচনা করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।

তিনি বলেন, মোদি সরকার দ্বারা সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত নিপীড়ন হচ্ছেন। এ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করলে, হয়রানি ও জেলে যেতে হয়। মৌলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় দিন দিন পিছিয়ে পড়েছে ভারত।

জার্মানির সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে এক সাক্ষাৎকারে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে এমন কঠোর সমালোচনা করেন অমর্ত্য সেন।

ভারতে এখন গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্য সেন বলেন, একদমই না। স্বাধীনতার পরে এখানে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি দিন দিন অনেক বেশি খারাপ হচ্ছে। যদি আপনি সরকারে বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা বলেন তবে আপনাকে হায়রানির শিকার হতে হবে, হয়তো বা জেলে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে।

গত কয়েক বছরে ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ সমীহ করার মতো। কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণে এ প্রবৃদ্ধি খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

অমর্ত্য সেন বলেন, বৃহৎ অর্থে বলতে গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ ও ভারতে আগে জীবনযাত্রার মান যেমন ছিল এখন সেটা বদলেছে। সেটা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। এটা ঠিক, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে সমাজে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণে সেই সম্পদের ব্যবহার সঠিকভাবে হয়নি।

মৌলিক শিক্ষা ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে ভারত এখন বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবীদ। তিনি বলেন, এক সময় নানা খাতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। এখন তারা ভারতের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভালো করছে। সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সবার জন্য মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মত কাজ যেটা কেবল একটি দেশের সরকারই নিশ্চিত করতে পারে।

অনেকেই মনে করেন দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকলে ধীরে ধীরে দারিদ্র্য দূর হয়ে যায়। এটা কী সব সময় সত্যি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করে গণতন্ত্রের প্রয়োগের ওপর। যদি স্কুলে শিক্ষার মান যথেষ্ট ভালো না হয়, স্কুলের মান খারাপ হয়, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অস্তিত্বই না থাকে, বেশিরভাগ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা শুধু ধনীদের জন্য হয় তখন একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক অভিযোগ করতেই পারেন।

যদি রাষ্ট্র সেই অভিযোগ করার সুযোগ দেয়, যদি অভিযোগ শোনা হয় এবং রাষ্ট্র সেই অনুযায়ী নিজের নীতির পরিবর্তন ও সংস্কার করে তবে গণতন্ত্র ‍অবশ্যই ঘাটতি পূরণে বড় অবদান রাখতে সক্ষম। কিন্তু সেটা ঘটছে না। এখন আমরা খুবই দুর্ভাগা রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছি। ভারতে বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় ‍অংশ রাষ্ট্রের ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের সেটা করতে দেয়া হচ্ছে না। সরকারের বিরোধিতা করলে বিভিন্ন ‍অজুহাতে জেলে ঢোকানো হচ্ছে।

অমর্ত্য সেন তার লেখা বই ‘দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস’ এ নীতি ও ন্যায় ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসন ব্যবস্থায় এ নীতি ও ন্যায়ের কতটা প্রয়োগ হচ্ছে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর?

এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত একদমই হচ্ছে না। আপনি যদি ভারতের সংখ্যালঘুদের দিকে তাকান তবে দেখবেন গত কয়েক বছরে তারা খুবই কঠিন সময় পার করছেন। দেশ এখন সংখ্যাগরিষ্ঠদের সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তাতে তো কোনো পার্থক্য হওয়ার কথা না। দেশে অন্য ধর্মের মানুষদের তুলনায় হিন্দু বেশি। এটা যদি সংখ্যালঘুদের দমনে ব্যবহার করা হয়, তাদের মত প্রকাশ করতে না দেয়া হয়, সব জায়গায় তাদের বঞ্চিত করা হয়, সেটা ঠিক হবে না।

কিন্তু সেটাই হচ্ছে, যেমনটা সম্প্রতি বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে হয়েছে বা কাশ্মীরসহ আরো অন্যান্য বিষয়ে হয়েছে। কাশ্মীর আগে একটি রাজ্য ছিল। হঠাৎ করেই সেটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে।

ভারতের প্রতিটি ‍নাগরিকের সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে জানিয়ে এ নোবেলজয়ী বলেন, হিন্দুরা যেমন ভারতের নাগরিক। ঠিক একইভাবে মুসলমানরাও ভারতের নাগরিক। মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অন্যান্যরা বার বার এ বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। কিন্তু এখন যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে সেটা খুবই দুঃখজনক নীতি। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে খারাপ নীতি।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের পোশাক খাত সংকটে পড়েছে। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে শ্রমিকদের রক্ষায় সরকারের কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ইউরোপ বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সবার জন্য সমাধানের পথ একটাই। প্রচুর পরীক্ষা, ব্যাপক ভাবে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা এবং ‍সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। বাংলাদেশের পোশাক খাতেও এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। তারা হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠার মতো ব্যবস্থার দিকে গেছে। বাস্তবে যেটা কাজে আসেনি।

আমার মনে হয় বাংলাদেশ ও ভারতের অন্য কিছু করা উচিত ছিল। তাদের ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের দিকে তাকানো উচিত ছিল। মহামারি তাদের অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পরেনি।

সূত্র: ডয়চে ভেলে

আপনি আরও পড়তে পারেন