দিনাজপুরের সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবনচিত্র

দিনাজপুরের সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবনচিত্র

আজিজুর রহমান,হাবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ

১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন! ইংরেজ শাসন, জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠে বীরভূমির মাটিতে। নেহায়েত দেশিও অস্ত্র নিয়ে আধুনিক বন্দুক-কামানের মুখোমুখি হয়েও কাঁপিয়ে দিলো ব্রিটিশ মসনদ।

সিধু,কানু,চান্দু ও ভৈরবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বছরের মাথায় বিদ্রোহ স্তিমিত হল বতে।কিন্তু গোটা ভারতের মোহনিন্দ্রা ভেঙে দিয়ে জন্ম নিলো অধিকার সচেতনতা। তার দলিল ঠিক পরের বছর থেকেই এই মাটিতে একের পর বিদ্রোহ। আর এর মধ্যদিয়ে আলোচনায় আসে একটি আদিবাদী জনগোষ্ঠী।

হ্যাঁ বলছিলাম,ইতিহাসের পাতায় স্বর্ন অক্ষরে লেখা সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা! আজ আমরা জানবো দিনাজপুরের সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবনচিত্র।

১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পরাজয়ের ফলে আবার বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাংলা,ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায়।বাংলাদেশে অধিক সংখ্যক সাঁওতাল আদিবাসীর উত্তরবঙ্গে বসবাস করে।

উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগের বৃহত্তম জেলা দিনাজপুরের কাহারোল, বীরগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ি, চিরিরবন্দর উপজেলায় অধিক সংখ্যক সাঁওতাল আদিবাসীর বসবাস।খুব সম্ভবত সাঁওত বা সামন্তভূমিতে বাস করার কারণে সাঁওতাল নামে পরিচিতি হয়ে পড়েছে।কোল ও মুণ্ডারি ভাষার সাথে সাঁওতালি ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে।

সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রিক ভাষার পরিবারভুক্ত। কোল ও মুন্ডারি ভাষার সঙ্গে সাঁওতালি ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। সাঁওতালদের সংস্কৃতিচর্চায় লিখিত সাহিত্যের বিকাশ না ঘটলেও লোকগীতি ও লোককাহিনীর সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে।

সাঁওতালদের যেমন ভাষা আছে কিন্তু লিখিত বর্ণমালা নেই, তেমনি তাদের ধর্ম আছে কিন্তু কোন আনুশাসনিক ধর্মগ্রন্থ নেই। বর্তমান খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা তাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হচ্ছে।

দিনাজপুর জেলার অধিকাংশ সাঁওতাল ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করলেও সাঁওতালদের নিজস্ব একটি ধর্ম রয়েছে। যার নির্দিষ্ট কোন নাম পাওয়া যায় নি। তবে এ ধর্ম কিছুটা হিন্দু ও কিছুটা বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রণ বলে মনে হয়।

সাঁওতালরা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা, এরা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কৃষিসংস্কৃতির জনক ও ধারক হিসেবে স্বীকৃত।সাঁওতাল সমাজ প্রধানত কৃষিজীবী। আর্থ-সামাজিক কারণে দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। তাই বাধ্য হয়ে অতি অল্প বিনিময়মূল্যে এরা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকে।

এছাড়া এরা মাটি কাটে, মোটকথা দিনমজুরির কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন প্রদক্ষেপে শিক্ষা ও প্রযুক্তির বিস্তারের ফলে তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।

সাঁওতাল সমাজে পুরুষের আধিপত্য অপেক্ষাকৃত বেশি। তবুও পারিবারিক জীবনে নারীর ভূমিকা কম নয়। জীবিকা অর্জনে বা কর্মজীবনে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সাঁওতালদের ঘর ছোট, কিন্তু গৃহাঙ্গন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন।

মাটির দেয়ালে নানারকম কারুকার্য চিত্র। সাঁওতাল নারীর সৌন্দর্য স্পৃহা ও শিল্পমনের পরিচয় তুলে ধরে। ঘরের আসবাবপত্র খুবই সাদামাটা যা তাদের সরল জীবনরীতির পরিচায়ক। সাঁওতাল সমাজ বর্তমান সময়ও ঐতিহ্যবাহী পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় পরিচালিত এবং গ্রাম প্রধানরা বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে থাকে।

সাঁওতালদের মধ্যে এখনও ১২টি গোত্রবিভাগ রয়েছে। কিস্কু, হাঁসদা, মুর্মু, হেমব্রম, মাণ্ডি, সরেন, টুডু, বাস্কে, বেশরা, চঁড়ে, পাঁউরিয়া ও বেদেয়া। সাধারণ নিয়মে একই গোত্রের ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তু এসব অনুশাসন এখন ততটা সচল নয়।

সাঁওতাল পুরুষরা আগে সাদা থান কাপড়ের ধুতি পড়তেন। বর্তমানে লুঙ্গি, ধুতি, গেঞ্জি, গামছা ব্যবহার করে। নারীরা ফতা নামের দুই খণ্ডের কাপড় পরে থাকে। বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে এবং ব্যবহার করতে দেখা যায় বাঙালি পোশাক।

সাঁওতালদের প্রধান খাদ্যের মধ্যে রয়েছে,ভাত, মাছ, কাঁকড়া, শুকর, মোরগ, বন জঙ্গলের পশু, পাখি, খরগোশ, গুইসাপ, ইঁদুর বেঁজির মাংস এদের খুবই প্রিয় খাবার।

সাঁওতালরা খুবই উৎসবপ্রিয় জাতি। বাঙালিদের মতো এদেরও বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাদের বছর শুরু হয় ফাল্গুন মাসে। প্রায় প্রতিমাসে বা ঋতুতে রয়েছে পরব বা উৎসব যা নৃত্যগীতবাদ্য সহযোগে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

নববর্ষের মাস ফাল্গুনে যেমন অনুষ্ঠিত হয় স্যালসেই উৎসব, তেমনি চৈত্রে বোঙ্গাবোঙ্গি, বৈশাখে হোম, আশ্বিনে দিবি, পৌষ শেষে সোহরাই উৎসব পালিত হয়। সোহরাই উৎসব সাঁওতালদের একপ্রকার জাতীয় উৎসব যা পৌষ সংক্রান্তির দিন অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উৎযাপিত হয়।

ফসলের দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশও এ অনুষ্ঠানের অঙ্গ। নাচ-গান-বাদ্য আর ফুলের মনোরম শোভায় এবং সেইসঙ্গে আহার্যে-পানীয়ে উৎসবটি হয়ে ওঠে জমজমাট। সম্ভবত এর বড় আকর্ষণ সাঁওতাল তরুণীদের দলবদ্ধ নৃত্য।

সাঁওতালদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের নাম বাহা অর্থাৎ ফুলফোটার উৎসব। বসন্তের শুরুতে এ উৎসবের উদ্দেশ্য নানা রঙের ফুলফোটার সৌন্দর্যকে অভ্যর্থনা ও অভিনন্দন জানানো হয়। এখানেও থাকে নাচ-গান ও বাদ্যের সমারোহ।

সাঁওতালরা যেকোনো বিশেষ উৎসবে হাড়িয়া (প্রিয় পানীয়) ব্যবহার করে থাকে। হাড়িয়া ছাড়া এ আদিবাসী জাতির বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানই সম্পন্ন হয় না। এটি তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে।

সাঁওতাল আদিবাসী সমাজে ছয় প্রকার বিবাহ রীতের প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তিন ধরনের বিবাহের প্রচলন দেখা যায়। যথা আসলি, রাজারাজি, হুর কাটারা বা ইতুর বিবাহ। সাধারণত ছেলের বয়স ১৯ ও মেয়ের বয়স ১৫-১৬ হলে বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে সাঁওতালিদেরও ওপর বাঙালি সমাজের প্রভাব পড়েছে। এদের অনেকে শিক্ষালাভ করে আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে।

বিয়ের বিদায়ের গান-
আতো গাতি কুড়ি কোড়া,
মায়া জালাং ছাড়া ফিঁদেই,
ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে,
ঈং রেনাং মায়া জালা মিনা,
আনাং মেন খান।
কাদাম বাতে চাপা দিন পে,
ত্রিয়ে ডুচিয়ে তে গেদু জিন পে,
দেউড়ে চিতাং কুলি শহর নূর।

ভাবার্থ: গ্রামের যতো যুবক যুবতী আছে/ মায়ার জালে আটকা তাদের কাছে/ ছিলাম আমি। এখন বোঙ্গার জালা/ ছিঁড়লো মায়া, আমার যাওয়ার পালা/ কদম ফুলে ইশারায় দিস্ ডাক/ আসবো আমি, মিথ্যে নয় এ হাঁক।

আগের দিনে মৃতদেহ দাহ করার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে অর্থনৈতিক কারণে দিনাজপুর সহ বাংলাদেশের সকল এলাকায় সাঁওতালরা মরদেহ কবর দেয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন