হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং হাবিপ্রবি

হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং হাবিপ্রবি

আজিজুর রহমানঃ


দিনাজপুরের তথা বাংলাদেশের রাজনীতিক গৌরব, পাক-ভারত উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা,ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হাজী মোহাম্মদ দানেশ।

যে নামটি মেহনতি, মুক্তিকামি, শোষিত মানুষের অনুপ্রেরণার প্রতীক।সেই কিংবদন্তি এই মানুষটি শুধু দিনাজপুর নয়, এই নেতা দিনাজপুরের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশ তথা সারা উপমহাদেশে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে আবির্ভুত হোন।এই রাজনৈতিক নেতার নামে দিনাজপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) এবং গ্রামের বাড়ি বোচাগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে রয়েছে একটি কলেজ ও এতিমখানা।


হাজী মোহাম্মদ দানেশের জন্ম তদানিন্তন বৃটিশ ভারতের প্রাচীনতম জেলা দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে ১৯০৩ সালে।বাবার নাম ছিল মৌলভী সালামত উদ্দীন।আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩১ সালে ইতিহাসে এম.এ এবং ১৯৩২ সালে বি.এল ডিগ্রি লাভ করে হাজী মোহাম্মদ দানেশ।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং উত্তরবঙ্গে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তাঁর নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়।

আন্দোলনকালে তিনি গ্রেফতার হন এবং কারাভোগ করেন (১৯৩৮)। নীলফামারি জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। সম্মেলনের পরপরই তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। বর্গাচাষীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান অব্যাহত রাখার কারণে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ঐ বছরই তিনি বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তিলাভ করেন।

এরপরই তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক পদে যোগ দেন।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রী দল নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে গণতন্ত্রী দল যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। যুক্তফ্রণ্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৫৪ সালে দিনাজপুর থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন।


কিন্তু তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান অব্যাহত রাখার কারণে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ঐ বছরই তিনি বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তিলাভ করেন। এরপরই তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক পদে যোগ দেন।


হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রী দল নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে গণতন্ত্রী দল যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৫৪ সালে দিনাজপুর থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫৭ সালে গণতন্ত্রী দল বিলোপ করে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি কারারুদ্ধ হন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নির্বাচিত হন।হাজী দানেশ মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন।


হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।

বাকশাল সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন পুনরুজ্জীবিত করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে এই দল বিলোপ করে হাজী দানেশ গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৮৬ সালে গণতান্ত্রিক পার্টি জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত করা হয়। হাজী মোহাম্মদ দানেশ জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন জাতীয় কৃষক পার্টির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন।

১৯৮৬ সালে তিনি দিনাজপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ তেভাগা আন্দোলনের নেতা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।


হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দিনাজপুরের বাঁশেরহাট নামক স্থানে অবস্থিত একটি সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ২য় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তেভাগা আন্দোলন এর জনক এবং এ অঞ্চলের জনদরদী কৃষকনেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। এটি উত্তর বাংলার সেরা বিদ্যাপীঠ যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে শীর্ষস্থানীয়।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু ১৯৭৬ সালে এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট (AETI) হিসেবে যা কৃষিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদান করতো।

১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর এটিকে স্নাতক পর্যায়ে কৃষি কলেজে উন্নীত করা হয়। এটি তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর অধিভুক্ত কলেজ ছিল। 
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেয়া হয়। এটিই বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।

২০০০ সালে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার লক্ষে “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প” গ্রহণ করা হয়। ৮ জুলাই ২০০১ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করা হয়। ২০০২ সালের ৮ এপ্রিল মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

১৬ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বিশিষ্ট মৃত্তিকা বিজ্ঞানী প্রফেসর ড: মো: মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। এটি উত্তরবঙ্গ তথা রংপুর বিভাগের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। কোর্স-ক্রেডিট-সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত।মাত্র একটি অনুষদ ও সামান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ২৩ টি ডিগ্রী দেয়া হচ্ছে,আছে ৯ টি অনুষদ ও ৪৫ টি বিভাগ।


ক্যাম্পাস এর পাশেই ঢাকা -দিনাজপুর মহাসড়ক অবস্থিত৷ দিনাজপুর শহর হতে ক্যাম্পাস এর দূরত্ব মাত্র ১০ কি.মি.। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সবুজ গাছপালার সমারোহ। আছে লাল-সাদা ইটের দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল ভবন, আছে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার, জিমন্যাশিয়াম, টিএসসি, ক্যান্টিন।


বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থী(প্রায় ২০০ জন) এখানে পড়াশুনা করছেন, যা আমাদের ও দেশের জন্য গর্বের। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ সুবিধার মধ্যে আছে আছে  ৫ টি একাডেমিক ভবন (১০ তলা একটি নির্মাণাধীন),কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ(এসি) সহ দুটি জামে মসজিদ,কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার,একটি অত্যাধুনিক প্রশাসনিক ভবন, ৫টি ছাত্র হোস্টেল(একটি বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য )* ৪টি ছাত্রী হোস্টেল( একটি নির্মাণাধীন), আধুনিক সাজসজ্জা বিশিষ্ট ১০০/১৫০ আসনের দুটি  ভিআইপি কনফারেন্স রুম, ৭০০(নন এসি) ও ২৮০ আসন(এসি ) বিশিষ্ট দুটি অডিটোরিয়াম, দুটি উন্নত মানের গেস্ট হাউজ,ভার্চুয়াল ক্লাসরুম।


দিনাজপুরের মিনি চিড়িয়াখানা খ্যাঁত উট পাখি সহ বিভিন্ন পশুপাখির জন্য গবেষণা ফার্ম,সাথে  মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি হ্যাচারী। এছাড়াও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ করতে রয়েছেন ৩০৯ জন শিক্ষক(বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট),২০০ জনের অধিক কর্মকর্তা,প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী এবং কয়েকশত কর্মচারী, পাশাপাশি তাদের জন্য আছে বিভিন্ন  ক্লাব ও সংগঠন,১টি শিশুপার্ক, পোষ্ট অফিস, রূপালী ব্যাংক শাখা, মেঘনা ব্যাংক শাখা, শ্রমিক ব্যারাক, নিজস্ব বৈদ্যুতিক লাইন,বৃহৎ খেলার মাঠ, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।

গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সমন্বয় ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (আই.আর.টি.)। আছে একটি ভি. আই. পি গেস্ট হাউস, হাবিপ্রবি স্কুল, ডাক্তার ও এ্যাম্বুলেন্সসহ একটি মেডিক্যাল সেন্টারও।

গবেষণালব্ধ থিসিস, রিপোর্ট, জার্নালের পাশাপাশি রয়েছে ৪০ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালির আকর্ষণীয় সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন