ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান

ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান

জুনইদ কবির, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধিঃ

ঠাকুরগাঁও জেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৮৪ সালে ১ ফেব্রুয়ারি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঠাকুর পরিবার ও হিন্দু ব্রাহ্মণদের সংখ্যা বেশি থাকার কারণে এই জায়গার নাম হয়েছিলো ঠাকুরগাঁও। এ জেলার আয়তন ১ হাজার ৮০৯ দশমিক ৫২ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৭ জন।
১৮০০ সালে ঠাকুরগাঁও থানা স্থাপিত হওয়ার পর ১৮৬০ সালে সদর, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল, হরিপুর ও আটোয়ারী নিয়ে ঠাকুরগাঁও মহকুমার যাত্রা শুরু। পরে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার পঞ্চগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ ও তেতুলিয়া এ ৪ থানা ঠাকুরগাঁও মহকুমার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৮১ সালে আটোয়ারীসহ এই ৪থানা নিয়ে পঞ্চগড় মহকুমার সৃষ্টি হলে ঠাকুরগাঁওয়ের সীমানা বর্তমান ৫টি উপজেলা নিয়েই গঠিত হয়

এই জেলার ৫ উপজেলায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় নিদর্শন। এরমধ্যে রয়েছে ২০০ বছরের পুরনো জামালপুর জমিদার বাড়ি জামে মসজিদ, ১০৩ বছরের পুরনো রাজা টঙ্কনাথের রাজবাড়ি, ৮০০ বছরের পুরনো রামরাই দিঘি, ২০০ বছরের পুরনো সূর্যপুরী আমগাছ, জিনের বালিয়া মসজিদ, ১০৭ বছরের হরিপুর রাজবাড়ি, যা দর্শনার্থীদের আকর্ষন করে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুরে জমিদার বাড়ির মসজিদটি নির্মাণ করা হয় ১৭৮০ সালে। ঐতিহাসিক এই মসজিদের দৈর্ঘ ৪১ ফুট ৬ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি। রয়েছে ৩টি গম্বুজ, ২৪টি মিনার ও ২টি বারান্দা। জমিদার বাড়ির এই মসজিদটি এক নজর দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ভিড় জমায়। অপরূপ এই মসজিদটির করেন তৎকালীন জমিদার আব্দুল হালিম। মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু করলেও তিনি মসজিদটি নির্মাণ শেষ করতে পারেননি। ১৭৮০ সালে জমিদার আব্দুল হালিম মারা যান। বেশ কয়েক বছর মসজিদের কাজ বন্ধ থাকার পর পরবর্তী জমিদার নূর মোহাম্মদ চৌধুরী আবারো মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ১৮০১ সালে এই কাজ শেষ করেন জমিদার নূর মোহাম্মদ চৌধুরী।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নে রয়েছে ঐতিব্যবাহী বালিয়া ‘জীনের মসজিদ’। মসজিদটির ছাদ প্রায় ১৭ ফুট উঁচু। ছাঁদে একই ধরণের ৩টি গম্বুজ ও ৮টি মিনার রয়েছে। যার মধ্যে চার কোণের ৪টি মিনার বড় এবং ৪টি ছোট। পুরো মসজিদই চুন-সুরকি এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে তৈরি। ইটে কোনো কাজ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে কলস, ঘণ্টা, ডিশ, বাটি, আমলকি,পদ্ম ইত্যাদি নকশা তৈরি করা হয়েছে। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, কোন এক আমবস্যার রাতে জীনেরা বালিয়া এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় এই মসজিদের একটি অংশ তৈরি করেছিলো। পরে স্থানীয় চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা এই মসজিদটির বাকীটুকু তৈরি করেন।
রাণীশংকৈল উপজেলায় রয়েছে ১০৩ বছরের পুরো রাজা টঙ্গনাথের রাজবাড়িটি। ১৯৯৫ সালে এটি নির্মাণ করেন রাজা টঙ্কনাথ। এই জনপদ ১১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মালদুয়া পরগণার অন্তর্গত ছিল। তাই এই রাজবাড়ি মালদুয়ার রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশ সরকারের আস্থা পেতে রাজা বুদ্ধিনাথের ছেলে টঙ্কনাথ এখানে ‘মালদুয়ার কোট’ স্থাপন করেছিলেন।পরে রাজা টঙ্কনাথের স্ত্রী রাণী শংকরী দেবীর নামে এই এলাকার নাম হয় রাণীশংকৈল।রাজবাড়িতে ঢোকার প্রধান সড়কটির ওপর রয়েছে একটি সুন্দর সেতু। একটু এগোলেই চোখে পড়ে রাজবাড়ির প্রধান ভবন।

এককালে জাকজমকপূর্ণ কারুকাজে খচিত এই প্রাচীন রাজভবনটির দেয়ালে এখনো অনেক কারুকাজ স্পষ্ট দেখা যায়।
প্রতিবার শীতে রাণীশংকৈল উপজেলার ৮শ বছরের পুরনো রামরাই দিঘীতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে অতিথি পাখি। এসব পাখির আগমনে পুরো দিঘির এলাকা পাখির রাজ্যে পরিনত হয়। প্রকৃতির এ রূপটাকে বাড়িয়ে দিতে প্রতি বছর এই শীতে আসে অতিথি পাখিরা। আর সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে রামরাই দিঘির পাড়ে লিচু গাছে আশ্রয় নেয় অতিথী পাখিরা। ভোর হলেই আবারো খাবারের সন্ধানে তারা রামরাই দিঘিতে সাতাঁর দেয়। এসব পাখিদের মিলনমেলা দেখতে প্রতিদিন দুর-দুরান্ত থেকে রামরাই দিঘিতে ছুটে আসেন পাখিপ্রেমীরা।
বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার মন্ডুমালা গ্রামে পুরো ২ বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে এশিয়া মহাদেশের সবচে বড় ছড়ানো আমগাছ। গাছটির ডালপালা এমনভাবে ছড়ানো যা দূর থেকে দেখলে প্রশস্থ একটি পাহাড় বলে মনে হয়। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই সূর্যপুরী জাতের আমগাছটি ঠাকুরগাঁও জেলার একটি দর্শনীয় স্থান। গাছটি রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করেন ১৫ জন। প্রতিবছর অসংখ্য দর্শনার্থী এই আমগাছ দেখতে এখানে ভিড় জমায়।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের মুখে পুরোনো হরিপুর উপজেলার ‘জমিদার বাড়ি।ভবনটি নির্মাণ হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। জমিদার বাড়ির ভবনগুলোর ছাদ ভাঙা। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
আনুমানিক ১৪০০ খ্রীস্টাব্দের ঘনশ্যাম কুন্ডু নামে এক ব্যবসায়ী কাপড়ের ব্যবসা করতে আসেন ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে হরিপুর উপজেলায়।তখন মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম নারী এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। খাজনা দিতে না পারায় মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু কিনে নেন। ঘনশ্যামের বংশধরদের একজন রাঘবেন্দ্র রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৃটিশ আমলে হরিপুর রাজবাড়ির কাজ শুরু করেন।কিন্তু তার সময়ে রাজবাড়ির কাজ শেষ হয়নি। রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এই বাড়িতে থেকেই জমিদারি পরিচালনা করতেন জমিদার জগেন্দ্র নারায়ন রায়। ১৯৪৭ সালে দেশে ভাগের সময় স্বপরিবারে ভারতে চলে যান জমিদার জগেন্দ্র নাথ রায়। এরপর থেকেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে আছে জমিদার বাড়িটি।
রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণ যেমন আকর্ষনীয় স্থাপত্য শৈলীর প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তেমনি গড়ে তুলেছিলেন একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাজর্ষির এই অনুরাগ শুধু তার ব্যক্তিগত রুচির পরিচয়ই বহন করে না, গোটা হরিপুরবাসীর মানসিকতাও তুলে ধরে। এখন অবশ্য পাঠাগারটির অস্তিত্ব নেই। রাজবাড়িটির যে সিংহ দরজা ছিলো তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভবনটির পূর্বপাশে একটি শিব মন্দির এবং মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি নাট মন্দির। ১৯৯০ সালের দিকে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হলে হরিপুর রাজবাড়িও দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। রাঘবেন্দ্র – জগেন্দ্র

আপনি আরও পড়তে পারেন