ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রশাসনের উদাসীনতায় গ্রাম্য সংঘর্ষ টেটাযুদ্ধের বাণিজ্য থামাবে কে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রশাসনের উদাসীনতায় গ্রাম্য সংঘর্ষ টেটাযুদ্ধের বাণিজ্য থামাবে কে

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: থেকে হাসান জাবেদ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলাতে গ্রাম্য সংঘর্ষকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় কাইজ্জা। এই কাইজ্জা আর টেটাযুদ্ধ নিয়ে নতুন করে বলার অপেক্ষা থাকে না। সকলেরই জানা আছে এই সংর্ঘষ নিয়ে। আধুনিক যুগে এই সংর্ঘষ সবাইকে অবাক করে তুলে। দেশে গ্রামীন সংর্ঘষের জনপদ হিসাবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পান থেকে চুন খসে পড়লেই দা, লাঠি, টেঁটা, ফলা ও বল্লমের মতো দেশীয় মারণাস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ। যুগ যুগ ধরে চলা এসব গ্রাম্য সংঘর্ষে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের।

ইতিহাসে জানা যায় আদিম যুগে পশু শিকারের জন্য মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে রাম দা, টেটা, কুচ, বল্লম, এক কাইট্টা, তীর ধনুক, সংর্ষের কথা সবাই জানে। তবে বর্তমানে ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এমন কোন দিন নেই কাইজ্যা নেই। মানুষ যখন প্রতিনিয়ত আধুনিক হতে চলেছে ঠিক এই সময়ে এই জেলায় প্রতিনিয়ত সংর্ঘষ অবাক করে তুলছে সবাইকে ।

সম্প্রতি কয়েকদিন বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে অনুসন্ধানকালে জানা যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে বেশি সংঘর্ষ হয়। নাসিরনগর, নবীনগর, আশুগঞ্জ ও সরাইল উপজেলায় বেশি। বাকি ৫ টি উপজেলায় ও সংর্ঘষ চলে সারা বছর। এসব দাঙ্গায় মানুষ যেমন পুঙ্গত্ব বরণ করে পাশপাশি আর্থিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। পাশপাশি সারা বছর মামলার ভারে নজু হয়ে থাকে দাঙ্গাবাজরা।

যে কোন সংঘর্ষের আগে গোষ্ঠীপ্রধানরা দরবারে বসেন। টেটাযুদ্ধের সিন্ধান্তের পর মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়। মাইকের ঘোষণা শুনে হাতে টেটা-বল্লম, আবার কারো হাতে গুলতি কিংবা লাঠিসোটা নিয়ে পরস্পরের প্রতি ধেয়ে যান তারা। ঘরের নারীদের সঙ্গে থাকে মরিচের গুঁড়া। এই রক্তক্ষয়ী টেটাযুদ্ধের নেপথ্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর বাণিজ্য। গোষ্ঠী প্রধানদের আধিপত্য ধরে রাখা এবং রমরমা বাণিজ্যের কারণে এই অঞ্চলে টেটাযুদ্ধ চলছে প্রায় একশত বছর ধরে।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে।
শত বছর ধরে চলছে টেটাযুদ্ধ। যে কোন সংঘর্ষের আগে গোষ্ঠী প্রধানরা দরবারে বসেন। সেখান থেকেই সিন্ধান্ত আসে টেটাযুদ্ধের। সিন্ধান্তের পর মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়। মাইকের ঘোষণা শুনে হাতে টেটা-বল্লম, আবার কারো হাতে গুলতি কিংবা লাঠিসোটা নিয়ে পরস্পরের প্রতি ধেয়ে যান তারা। ঘরের নারীদের সঙ্গে থাকে মরিচের গুঁড়া। দুইপক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তারা বাতাসে উড়িয়ে দেয় সেই মরিচের গুঁড়া। এই গুঁড়া বাতাসের অনুকূলে উড়ে গিয়ে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে সহায়ক হয়। এই মারামারিকে কেন্দ্র করে অনেক আয়োজন করে খাবার রান্না করা হয়। দেখে মনে হয় যেন উৎসব চলছে।

প্রতিটি টেটাযুদ্ধে মোটা অংকের টাকা আসে বিদেশ থেকে। টেটা – বল্লম বানানো, মারামারিতে অংগ্রহণকারীদের খাওয়ানো, প্রশাসন সামলানো, মামলা ও আদালতের খরচ চালানোর জন্য গোষ্ঠীর অবস্থা সম্পন্নদের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের চাঁদা তোলা হয়। পাশাপাশি নিজেদের গোষ্ঠীর যারা বিদেশে থাকেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা দাবি করে মাতব্বরা। নিজের গোষ্ঠীর আধিপত্যের কথা চিন্তা করে বিদেশ থেকে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকাও পাঠান একেক জন করে।

পুলিশের ভাষ্য মতে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে নিজেদের পেশিশক্তি দেখানোর জন্য গ্রামের সর্দাররা দাঙ্গা লাগিয়ে রাখেন। এলাকায় যার আধিপত্য থাকে তিনি আর্থিকসহ নানা সুবিধা ভোগ করেন। এর ফলে ছোট-খাটো ঘটনাগুলোকে সংঘর্ষে রূপ দেন ওই গ্রাম্য সর্দার-মাতব্বররা। প্রতিটি সংঘর্ষের ঘটনায় থানায় মামলা হয়। আর মামলা চালানোর জন্য আসামিদের কাছ থেকে তোলা হয় চাঁদা। এই চাঁদার বেশিরভাগ টাকা নিজেদের পকেটে ঢোকান সর্দাররা।

পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের হিসেব বলছে, গত দুই বছরের সরাইল, নবীনগর, নাসিরনগরসহ এ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১৪৩৭ টি মারামারির ঘটনা ঘটেছে। আর এসব ঘটনায় মারা গেছেন ১৫১ জন। আহত হয়েছেন ৭১৮৫জন। 

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, আমরা যাতে এলাকায় যাতে আর কোন সংঘর্ষ না হয় সেজন্য কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এলাকাবাসীকে সচেতন করছি। এলাকার জনপ্রতিনিধিদেরকে নিয়ে এলাকায় যাতে ঝগড়া-ঝাটি না হয় সেজন্য কাজ করছি। তাছাড়া যেগুলোর মামলা হয়েছে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসামী গ্রুেফতার করছি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

পুলিশ বলছে সংঘর্ষ তাদের নিয়ন্ত্রনে। আর মনোবিজ্ঞানীরা বলছে সু-শিক্ষা ও বিকৃত মন মানসিকতার অভাবের কারনে এই ধরণের সংঘর্ষ চলে বিভিন্ন গ্রামে  চলে এই সংর্ঘষ।

পুলিশ যত কথা বলুক না কেন বন্ধ হচ্ছেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংর্ঘষ। তবে মানুষের চিন্তা চেতনা আর মানসিকতার পরিবর্তন হলে একদিন বন্ধ হতে পারে এখানকার সংর্ষষ এমনটাই মনে করেন এই এলাকার  সাধারন মানুষ।

আপনি আরও পড়তে পারেন