বাবুলের পরকীয়ার জেরেই খুন হতে হয় মিতুকে

বাবুলের পরকীয়ার জেরেই খুন হতে হয় মিতুকে

এক বিদেশিনীর সঙ্গে স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের পরকীয়া সম্পর্কের জেরেই খুন হতে হয় স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে। স্বামীর অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি তিনি জেনে ফেলেন। তাই বিষয়টি কোনোমতেই মেনে নিতে পারছিলেন না মিতু। এ নিয়ে তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরে। বিষয়টি নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হলে মিতুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন বাবুল।

ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, বাবুল নিজেই ছিলেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডের জিইসি মোড় এলাকায় গুলি এবং উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে মিতুকে খুন করে দুর্বৃত্তরা। মিতু হত্যার মিশনে ছিল সাত থেকে আট জন, যার নেতৃত্বে ছিল বাবুলের দীর্ঘদিনের বিশস্ত সোর্স মুসা। এজন্য মুসাকে ৩ লাখ টাকা পারিশ্রমিকও দিয়েছিলেন বাবুল। মিতু হত্যার তিন দিন পর বাবুল তার ব্যাবসায়িক পার্টনার সাইফুলের মাধ্যমে কাজী আল মামুন নামে এক ব্যক্তির কাছে বিকাশে এই টাকা পাঠান। পরে মামুন তার আত্মীয় মুসাকে এই টাকা দিয়ে দেন। গত মঙ্গলবার (১১ মে) সাইফুল ও কাজী আল মামুন উভয়েই এ বিষয়ে চট্টগ্রামের একটি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঐ জবানবন্দির পরই মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মিতু হত্যায় বাবুলের সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হয়।

এই ঘটনার পরদিন মিতু হত্যার অভিযোগে তার স্বামী বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে আট জনের বিরুদ্ধে নতুন একটি মামলা করা হয়েছে। গত বুধবার (১২ মে) মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলাটি করেন। মামলা দায়েরের পর মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তার একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, মামলা তদন্তে ঘটনার সঙ্গে বাবুল আক্তারেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তারা ঐ মামলার ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়ে নিষ্পত্তি করেছেন। যেহেতু তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানিয়েছেন, তাই আমি তাকে প্রধান আসামি করে মোট আট জনের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করেছি। বাকি সাত জন আসামির সম্পৃক্ততা এর আগে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলা তদন্তে পাওয়া গেছে।’

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গায়ত্রী অমর সিং নামে এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত ছিলেন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ফিল্ড অফিসার গায়ত্রীর সঙ্গে বাবুলের সম্পর্ক হয়। তাদের অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি মিতু জেনে ফেলায় তাদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। পরে বাবুল ও গায়ত্রী মিতুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেন।’ গায়ত্রীকে মামলার আসামি করা হয়নি কেন জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, এজাহারে তার নাম উল্লেখ করা আছে। তার (গায়ত্রীর) সম্পৃক্ততা আছে কি না তা তদন্ত কর্মকর্তা দেখবেন।

চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাবুলসহ আট জনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় নতুন একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার বাকি সাত আসামি হলেন মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ভোলা, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু ও শাহজাহান মিয়া।

আট আসামির মধ্যে মোতালেব মিয়া ও আনোয়ার হোসেন আগের মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। মিতুর বাবার দায়ের করা নতুন মামলায় আসামি মোতালেব মিয়া ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার দেখানোর অনুমতি দিয়েছে আদালত। গতকাল রবিবার শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট শফী উদ্দিন এ অনুমতি দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা এ দুজনকে গ্রেফতার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন। এ নিয়ে এই মামলার এজাহারভুক্ত আট আসামির মধ্যে প্রধান আসামি মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারসহ চার জনকে গ্রেফতার করা হলো। এছাড়া শাহজাহান নামে আরো এক আসামিও কারাগারে রয়েছেন। আজ সোমবার তাকে গ্রেফতার দেখানোর জন্য আবেদন করা হবে বলে পিবিআই সূত্র জানিয়েছে। বাবুল আক্তারকে গত বুধবার নতুন মামলার পর গ্রেফতার করে পিবিআই। এছাড়া সাইদুল ইসলাম সাক্কুকে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।

রিমান্ডে মুখ খুলছেন না বাবুল আক্তার

বাবুল আক্তারকে গ্রেফতারের পর আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পিবিআই। শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট (তৃতীয় আদালত) সারোয়ার জাহান পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আজ সোমবার তার রিমান্ড শেষ হবে। তবে পিবিআই সূত্র জানায়, রিমান্ডে মুখ খুলছেন না বাবুল আক্তার। তিনি তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথা-বার্তাই বলছেন। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন। তার নার্ভ যথেষ্ট শক্ত আছে।

এ বিষয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, মিতু হত্যায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি রিমান্ডে যদি কিছু নাও বলেন তবুও এই হত্যাকাণ্ডে তার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজন মনে করলেও তাকে পুনরায় রিমান্ডে নেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন।

দুই সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ

এদিকে মিতু ও বাবুলের দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির ও তাবাসসুম তাজনীন টাপুরকে এখনো খুঁজে পায়নি পিবিআই। এদের মধ্যে মাহির তার মায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। মাহিরকে পাওয়া গেলে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন