হামরা চাই বেড়িবাঁধ, সরকার দেয় বস্তা

হামরা চাই বেড়িবাঁধ, সরকার দেয় বস্তা

‘প্রত্যেক বছর বন্যা হয়। হামার দুঃখ-কষ্টের শ্যাষ থাকে না। কত মাইনসে এই তিস্তা নদীত ঘর-বাড়ি হারাইছে। তাতে সরকারের কী? নদীপাড়ের মাইনসের কপাল খারাপ। ওই তকনে হামরা চাই বেড়িবাঁধ। সরকার হামার দেয় সস্তা জিওব্যাগ। বস্তা দিয়্যা যদি ভাঙন ঠেকা গেইল হয়, তাইলে কি হামরা বেড়িবাঁধ চাই বাহে? সরকারোক কন হামার পাকে একনা দেকুন।’

বুকভরা কষ্ট আর মুখভরা আক্ষেপ থেকে কথাগুলো বলছিলেন নওশা ঘাটিয়াল। গেল কয়েকদিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়েছে তিস্তা অববাহিকায়। ওপার বাংলার গজল ডোবা তিস্তা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।

উজানের পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় এপার বাংলার বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাটের সব কটিই খুলে দিতে হয়েছে। অব্যাহত পানি বাড়া-কমায় রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় দেখা দিয়েছে বন্যা।

পানির তোড়জোড়ে উপজেলার ৭ ইউনিয়নের নিমাঞ্চলসহ চরের ২৫ এলাকার আট হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া  তীব্র স্রোতে কোলকোন্দ ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের বেশকিছু চরের শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

পানিবন্দি দশায় থাকা অসহায় মানুষদের একজন নওশা ঘাটিয়াল। তিন দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পরিবারের অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে গেলেও গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন তিনি। শুক্রবার (২০ আগস্ট) বিকেলে গঙ্গাচড়ার পূর্ব বিনবিনায় দুর্ভোগের কথা জানান পানিবন্দি নওশা ঘাটিয়াল।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) রাত থেকে নদীতে পানি বৃদ্ধি হতে থাকে। শুক্রবার সকাল ৬ টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং গঙ্গাচড়া তিস্তা সেতু পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

পানিবন্দি পরিবার

তবে বেলা বাড়ার সাথে তা কমতে থাকে। দুপুর ১২টায় তিস্তা ব্যারাজে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিকের (৫২ দশমিক ৬০ সেমি) চেয়ে ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে তিস্তা বেষ্টিত নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন চরের অন্তত আট হাজার পরিবার বন্দিদশায় আছেন। চারদিকে পানি আর পানি। কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও কোমরপানি। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষজন নিজেদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।

ইতোমধ্যে কোলকোন্দ ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের বিভিন্ন চরের অন্তত ৭০-৮০ একর ফসলি জমি, শতাধিক ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পশ্চিম বিনবিনার পাকারমাথা এলাকার কাঁচা রাস্তাটিও পানির চাপে ভেঙে গেছে। আর তিন-চার ফুট ভাঙলেই নদী লোকালয়ে ঢুকে ফসলি জমি, ঘর-বাড়িতে হানা দেবে।

এতে পুরো বিনাবিনার চর গ্রামের ফসলি জমি ও শত শত ঘরবাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জিও ব্যাগ ডাম্পিং শুরু করেছে। এতে কোনো ভাঙন রোধ তো দূরের কথা কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের চরের ২ ওয়ার্ডসহ ও তিনটি ওয়ার্ডের বাঁধের ধারের প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। পূর্ব বিনাবিনার অনেক পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও মৎস খামারের কয়েক লাখ টাকার মাছ। তলিয়ে গেছে আমনখেত। ভাঙন রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়।

এছাড়া নোহালী ইউনিয়নের মিনার বাজার, নোহালী চর, বৈরাতি, বাঘডহরাসহ নিচু এলাকাগুলোতে প্রায় ১ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। গজঘন্টা, মর্নেয়া, আলমবিদিতর ও গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের বাঁধেরপাড়সহ নিম্নাঞ্চলে আরও ২ হাজার পরিবারের পানিবন্দি হয়ে থাকার সংবাদ পাওয়া গেছে।

পূর্ব বিনবিনার ও ইচলী গ্রামের হাসান আলী, ফজলু মিয়া ও নুর মোহাম্মদ জানান, বৃহস্পতিবার রাতের খাবার না খেতেই তিস্তার পানি বাড়ি হু হু করে ঢুকে। আতঙ্কে খাবার না খেয়ে আসবাবপত্র ও গরু ছাগল সরাতে থাকেন তারা।

ওই দিন রাতেই ভাঙন শুরু হলে বাড়ি সরাতে রাত কেটে যায়। পানির স্রোতে নদীগর্ভে অনেকের আসবাবপত্র ভেসে যায়। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অনেকের পেটে খাবার পড়েনি। বিকেলে ভাসমান চুলায় খোলা আকাশের নিচে কোনোরকমে রান্না করে খেয়েছেন।

লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, তার ইউনিয়নের বাগেরহাট, আশ্রয়ণ, পূর্ব ও পশ্চিম ইচলী, জয়রামওঝা, কলাগাছি, মধ্যইচলীসহ নিম্নাঞ্চলের অন্তত দুই হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। এছাড়াও পশ্চিম ইচলীর ৫০ পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। ভাঙন রোধে ছয় কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি।

এদিকে গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা বেগম জানান, তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের গ্রামসহ উপজেলার অন্তত ৩৫টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সরকারিভাবে বন্যাকবলিত মানুষদের জন্য ১০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন