শত বছর ধরে রশি টানছে ১০ গ্রামের মানুষ

শত বছর ধরে রশি টানছে ১০ গ্রামের মানুষ

এক দিকে সালথা উপজেলার মাঝারদিয়া, অপরদিকে নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া। এর মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদ। দুটি ইউনিয়নের অন্তত ১০ গ্রামের ৯ হাজার মানুষকে চলাচল করতে হয় এ নদের ওপর দিয়ে। কিন্তু নদ পার হওয়ার জন্য নেই কোনো সেতু। ফলে শত বছর ধরে রশি টেনে নৌকায় পার হতে হয় সবাইকে।

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার মাঝারদিয়া কুমার নদের ওপর একটি সেতু নির্মাণের অভাবে দুর্ভোগের শেষ নেই এসব গ্রামবাসীর। বছরের পর বছর দুর্ভোগ পেহালেও এখানে নির্মাণ করা হয়নি সেতু। এতে নারী, বয়স্ক ও শিশুদের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় বর্ষাকালে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সালথা ও নগরকান্দা উপজেলা সীমান্তের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদ। নদের পশ্চিম পারে রয়েছে সালথা আর পূর্ব পাড়ে রয়েছে নগরকান্দা উপজেলার সীমানা। মাঝে কুমার নদ। নদের মধ্যে রয়েছে একটি কাঠের নৌকা। নৌকাটির দুই মাথা প্রয়োজনমতো রশি বাঁধা। তবে নৌকায় মাঝি নেই। সাধারণ মানুষ নৌকায় উঠে নিজেরাই রশি টেনে এপার-ওপার পারাপার হচ্ছে।

এখান দিয়ে অনেক শিক্ষার্থীকেও পারাপার হতে হয়। পরিস্থিতি এমনও হয় শিশু শিক্ষার্থী বা শুধু নারীরা যখন পারাপারের অপেক্ষায় থাকেন, তখন তাদের নদের পাড়েই বসে থাকতে হয়। এরপর যখন কোনো পুরুষ পার হতে আসেন, তখন তিনি (পুরুষ) দড়ি টেনে সবাইকে নিয়ে পার হন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই জায়গায় নদের প্রস্থতা আনুমানিক ১১০ মিটার। নদের দুই দিক কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। মাঝের কিছু জায়গা পরিষ্কার করা। তার মাঝে একটি নৌকায় পার হতে হয়।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সালথার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের কুমারপট্টি, খলিশপট্টি, মাঝারদিয়া, নারানদিয়া, মুরাটিয়া, তুঘুলদিয়া গ্রাম এবং নগরকান্দার লস্করদিয়া ইউনিয়নের কল্যাণপট্টি, আইনপুর, কুমারকান্দা ও বাগাটা এই ১০টি গ্রামের অন্তত ১৬ হাজার লোকের পারাপারের এটিই সহজ পথ।

নগরকান্দা উপজেলার কল্যাণপুট্টি, কুমারকান্দা, আইনপুর ও বাঘুটিয়া গ্রামের তিন দিকেই কুমার নদে ঘেরা। একদিকে রয়েছে স্থলপথ, সেই পথ আবার অনেক দূরের। নিত্যপ্রয়োজনে বা বাজার করতে নিকটবর্তী সালথা উপজেলার মাঝারদিয়া বাজারেই যেতে হয় তাদের। সে ক্ষেত্রে নৌকা ছাড়া পারাপারের অন্য কোনো পথ নেই তাদের।

নদের দুই পারে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক পারে রয়েছে এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় মাঝারদিয়া বাজার। বাজারটি অনেক পুরোনো। স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করেন এই বাজারে। নগরকান্দার ওই পারে রয়েছে আইনপুর দাখিল মাদরাসা, আইনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সালথার এপারে রয়েছে মাঝারদিয়া দাখিল মাদরাসা, মাঝারদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের খেয়ানৌকায় নদ পার হতে হয়। বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীরা বেশি ঝুঁকি নিয়ে নদ পার হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়।

ওই এলাকার বাসিন্দারা মাঝারদিয়া কুমার নদের এ ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে। তবে তাদের দাবি পূরণ হয়নি। ফলে চরম বিপাকের মধ্য দিয়ে ঘাট পারাপার হয়ে আসছে তারা।

নগরকান্দার কল্যাণপট্টি গ্রামের বাসিন্দা কলেজছাত্রী স্মৃতি আক্তার বলেন, কলেজ খোলা থাকলে মাঝে মাঝেই এভাবেই ঘাটে এসে বসে থাকতে হয়। কারণ আমরা মেয়েরা রশি টেনে নৌকা পার হতে পারি না। অপেক্ষা করতে হয় পুরুষদের জন্য। বর্ষা মৌসমে প্রবল স্রোত থাকে নদে। তখন আরও বিপাকে পড়তে হয় আমাদের। অনেক সময় ঘাটে অপেক্ষা করার কারণে স্কুলে গিয়ে ক্লাস পাই না।

কল্যাণপুটি গ্রামের আমিনুর রহমান বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি এই কয়েক গ্রামবাসী নৌকা দিয়েই পারাপার হয়ে থাকে। আমাদের বিভিন্ন কাজের জন্য মাঝারদিয়া বাজারই একমাত্র ভরসা। একটু বৃষ্টি হলেই দুপাড়ের ঘাটে অনেক সমস্যায় পড়তে হয় কাঁদায়। এখানে কোনো অপরাধমূলক কাজ হলে পুলিশও দ্রুত আসতে পারে না। এ ছাড়া কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রামগুলোতে অ্যাম্বুলেন্সও প্রবেশ করতে পারে না, নৌকায় পার করে নিতে হয়।

মাঝারদিয়া গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মো. ইদ্রিস মাতুব্বর বলেন, শত বছর ধরে প্রতিদিন এই ঘাটে রশি টেনে নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছে দশ গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ। কৃষকরা মাথায় করে ফসল এনে ঘাটে এসে নৌকা দিয়ে পার হয়ে বাজারে আসে। এতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। আমাদের দেখার কেউ নেই।

মাঝারদিয়ার বাজার কমিটির সভাপতি মো. সেলিম মাতুব্বর বলেন, কুমার নদের এই ঘাটে সেতু নির্মাণের জন্য কয়েকবার জনপ্রতিনিধদের অবগত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সেতুর অভাবে আশপাশের অন্তত ১০ গ্রামের সাধারণ মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে নদটি পার হতে হচ্ছে।

সালথা উপজেলা প্রকৌশলী তৌহিদুর রহমান বলেন, মাঝারদিয়া কুমার নদের ঘাটে একটি সেতুর খুব প্রয়োজন বলে স্থানীয় কয়েকজন আমাকে জানিয়েছেন। আমাদের কাছে ১০০ মিটার ব্রিজের একটি প্রকল্প আসছে। আমরা কুমার নদের ওই ঘাটটি মেপে দেখব। যদি ১০০ মিটার হয়, তাহলে আমরা একটি সেতু নির্মাণ করে দিতে পারব।

আপনি আরও পড়তে পারেন