কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের মুখরোচক চ্যাপা-শুটকি বিদেশেও রপ্তানি হয়।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের মুখরোচক চ্যাপা-শুটকি বিদেশেও রপ্তানি হয়।
মাহফুজ হাসান, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ঃ
চ্যাপা ও শুঁটকি এমন একটি মুখরোচক খাবার যা যুগ যুগ ধরে বাঙালির রসনাবিলাসে প্রতিনিয়ত স্থান করে নিয়েছে। মাছ, মাংস আর অন্য যেকোনো ভোজন তালিকায় থাকুক না কেন? চ্যাপা_শুটকির সাথে জূড়ি নেই। তাই ভোজন রসিকদের কাছে চ্যাপার কদর দিনদিনই বেড়েই চলছে। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের চ্যাপার স্বাধের বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। তাই চ্যাপা শুঁটকি এমনই একটি নাম, যা শুনলেই বাঙালির জিবে জল এসে যায়। পান্তা ভাত আর চ্যাপা ভর্তা মিশিয়ে খাওয়ার স্বাধ অতুলনীয় ও অন্যরকম তৃপ্তিদায়ক। চ্যাপা ভর্তা একবার খেলে স্বাধ দিনঅবধি মুখে লেগেই থাকে।
কিশোরগঞ্জ তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে চ্যাপা অতি প্রিয় এক খাবারের নাম। একসময় কিশোরগঞ্জে হোসেনপুরের চ্যাপা গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল। দামও ছিল কম। কিন্তু এখন চ্যাপার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এটি উচ্চবিত্তদের মুখরোচক খাবার হয়ে উঠেছে।
শুধু কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর নয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় এখন অতি প্রিয় মুখরোচক খাবার চ্যাপা। এই চ্যাপা এমনই এক উপাদেয় খাবার, যা মুখের রুচি বাড়িয়ে দেয়।
হোসেনপুরের চ্যাপার কদর আছে সৌদিআরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের বাঙালি যেখানে অবস্থান করেন। চ্যাপা নানাভাবে খাওয়া হয়। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যাপাভর্তা। শুকনা মরিচ বা কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, রসুনের সঙ্গে শিলপাটায় বা হাতে পিষে চ্যাপাভর্তা করা হয়। চ্যাপার ভুনাও খুব জনপ্রিয় খাবার। চ্যাপা উনুনে পুড়িয়ে ভাজার তীক্ষ্ণ গন্ধে মন মাতোয়ারা হয়ে উঠে। শুকনো লাল মরিচ দিয়ে চ্যাপার ভর্তা তৈরি করতো বলে এক সময় এই চ্যাপার ভর্তাকে লাল মোরগের ভর্তা বলে ডাকত এ জনপদের মানুষ।
চ্যাপা কারিগরেরা শুঁটকি কিনে মাটির বড় বড় মটকায় চেপে চেপে জাগ দিয়ে পাঁচ থেকে ছয় মাস রেখে দেন। চ্যাপা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ‘পুঁটি মাছের তেল’। পুঁটি মাছের পেট থেকে যে নাড়িভুঁড়ি বের করা হয়, তা জ্বাল দিলেই এ তেল পাওয়া যায়। মটকার মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়, যাতে ভেতরে কোনো অবস্থাতেই বাতাস ঢুকতে না পারে। চ্যাপা তৈরির ক্ষেত্রে এই বায়ুনিরোধক প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মটকার ভেতরে বাতাস ঢুকলে তাতে চ্যাপা হওয়ার পরিবর্তে মাছ পচে যাবে। চ্যাপা তৈরি হয়ে গেলে বিভিন্ন হাটবাজারে খুচরা বিক্রির পাশাপাশি স্থানীয় আড়তদারেরা সেগুলো কিনে গুদামজাত করেন। প্রক্রিয়াজাত করে এসব চ্যাপা দেশের বিভিন্ন স্থানসহ রপ্তানি হয় বিদেশে।
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে হোসেনপুরের চ্যাপার খ্যাতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। অনেকে বিদেশ থেকে এলে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যান চ্যাপা। এমনকি দেশের বাইরের স্বজনদের আবদারও পূর্ণ করতে হয় এই এলাকার মানুষকে।  বর্তমানে কিশোরগঞ্জ ও হাওরবেষ্টিত অঞ্চলগুলো চ্যাপাশিল্পের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
 প্রতিটি মটকায় ৩০ থেকে ৪০ কেজি চ্যাপা ধরে। প্রকারভেদে এক মণ চ্যাপা ৫-৭ হাজার থেকে ৩৫-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। হোসেনপুর বাজারের চ্যাপার ব্যবসায়ী শামছুল, সেলিম ও রায়হান জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিদেশে যেসব এলাকায় বাংলাদেশিরা থাকেন। সেসব এলাকায় বিপুল পরিমাণ চ্যাপা তারা বিক্রি করেন। তারা বলেন, হোসেনপুরই বেশির ভাগ পুঁটি মাছের চ্যাপা তৈরি হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিটি মটকায় ৩০ থেকে ৪০ কেজি চ্যাপা ধরে। প্রকারভেদে এক মণ চ্যাপা ৫-৭ হাজার থেকে ৩৫-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। কেজি হিসেবে কিনলে পড়বে ২৫০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা।
চ্যাপা কারিগর ও ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পুঁটি মাছ সংগ্রহ করা হয়। তাছাড়াও হোসেনপুর বাজার থেকে প্রতিদিন খুচরা হিসেবে প্রতিদিন ১০–১৫ হাজার টাকা চ্যাপা বিক্রি করতে পারেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন