সাইদুল ও সোহেল হত্যায় আসামীদের স্বীকারোক্তি জবানবন্দি

সাইদুল ও সোহেল হত্যায় আসামীদের স্বীকারোক্তি জবানবন্দি

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

সাইদুল ও সোহেলের কী অপরাধ ছিল? তারা চাকরি চেয়েছিলেন। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে। দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তির আশায়। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য মানুষ কি না করে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে নৌপথে সমুদ্র পাড়ি দিতেও দ্বিধা করেনা। আর এই সুযোগ নেয় সমাজের কিছু নরপশু। যুব সমাজকে টার্গেট করে চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রতিশোধ হিসেবে হত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধাবোধ করেনা সমাজের মধ্যে ভালো মানুষের ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকরা। এমনই একটি নির্মম ঘটনার স্বীকার সাইদুল ইসলাম মৃধা ও সোহেল।

সাইদুল ও সোহেল দুজনে প্রতিবেশি ও ভালো বন্ধু। দরিদ্র পরিবারের সন্তান তারা। পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য সাইদুল তিন বছর কাতারে কাটান। কিন্তু সেখানেও ভাগ্যের চাকা ঘোড়াতে পারেনি। সুবিধা করতে পারেনি বলে চলে আসেন দেশে। এবার দুবাই যাওয়ার চেষ্টা সাইদুলের। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

সাইদুলের মা রাজিয়া বেগম বলেন, চাকরির জন্য দুই বন্ধু দেখা করেন পাশের গ্রামের সাজ্জাত মোল্লার সঙ্গে। সাজ্জাত মোল্লা দুজনকেই একই এলাকার চঞ্চল মোল্লার মাওয়া বালুর ড্রেজারে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন। কয়েকদিন পর ২০২১ সালের ২০শে এপ্রিল আনুমানিক সকাল ১০ টায় সাজ্জাত মোল্লা তার মোবাইল ফোন থেকে সাইদুলকে ফোন করে জানায়, এখনই মাওয়া যেতে হবে। চঞ্চল মোল্লা তারাতারি যেতে বলেছে। ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই সাজ্জাত মোল্লার সঙ্গে চঞ্চল মোল্লার কাছে যাচ্ছেন বলে সাইদুল আমাকে জানায়। তখন ছিল ঠিক রমজান মাস, প্রায় সন্ধ্যা। ইফতারির খবর নিতে আমি ছেলে সাইদুলের মোবাইলে ফোন করি। সাইদুল আমাকে জানায়, আমি সাজ্জাত কাকা ও চঞ্চল মামার সঙ্গে মাওয়াতে আছি। কাজ বুঝে নিতে রাত হবে তাই আজ আসবো না। কাল সকালে আসবো।

রাজিয়া বেগম আরও বলেন, পরের দিন সাইদুলের মোবাইলে ফোন দেই। কিন্তু মোবাইল বন্ধ পাই। এ ঘটনা জানিয়ে থানায় মামলা করতে যাই। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ সেদিন আমার মামলা/জিডি কিছুই নেয়নি। তিনদিন পর ২৩শে এপ্রিল আবার থানায় গেলে সেদিনও মামলা না নিয়ে জিডি নেন। এভাবে চার মাসেরও বেশি সসয় পার হয়ে যায়। কিন্তু ছেলের কোনো সন্ধান নেই। অবশেষে ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও দোহার আমলী আদালতে একটি মামলা দায়ের করি। পরে সিআইডির মাধ্যমে জানতে পেরি আমার ছেলে আর জীবিত নেই।

মামলায় আবেদনে উল্লেখ করা হয়, আসামি সাজ্জাত মোল্লার সঙ্গে আমার পুত্র সাইদুল মৃধার তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। সাজ্জাত মোল্লা আমার ছেলেকে বলে, সুযোগ পেলে তোকে দেখে নেব। এরপর স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন সাজ্জাত মোল্লা এবং আমার ছেলে সাইদুল মৃধার আপোষ করিয়ে দেয়। প্রতিবেশি হওয়ায় আমার ছেলে এবং সাজ্জাত মোল্লার মধ্যে ফের আন্তরিক সম্পর্ক হয়। একদিন আমার ছেলে সাইদুল করোনার কারণে বিদেশ যেতে না পারার কথা জানালে সাজ্জাত মোল্লা মাওয়াতে চঞ্চল মোল্লার ড্রেজারে চাকরি দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। এরপর পরের দিন ছেলেকে ফোন দিলে তার মোবাইল বন্ধ পাই। আমরা সাজ্জাত মোল্লা ও চঞ্চল মোল্লার বাসায় গিয়ে ছেলের সন্ধান জানতে চাই। তারা বলে আমরা তোমার ছেলের খবর জানিনা। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তোকেও তোর অন্য ছেলেদেরকে মেরে লাশ গুম করে ফেলবো।

রাজিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শ্রেষ্ঠ আহমেদ রতন বলেন, এ ঘটনায় রাজিয়া বেগম প্রথমে দোহার থানায় মামলা করতে যায় কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ সেদিন মামলা না নিয়ে দুই দিন পর জিডি নেন। পরে ছেলের সন্ধান না পেয়ে মা আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে তদন্তের আদেশ দেন। দোহার থানা মামলাটি গ্রহণ করে কিছুদিন তদন্ত কার্যক্রম করেন। তথ্য প্রযুক্তির বিষয় জড়িত থাকায় পরে দোহার থানা মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করেন। সিআইডির তদন্ত শুরু করেন। এক পর্যায়ে এ ঘটনায় সোহাগ ব্যাপারী ও ইয়াছিন মোল্লাকে আটক করে সিআইডি। তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবান্বন্দী দেন। বেড়িয়ে আসে সাইদুল ও সোহেলকে নির্মমভাবে হত্যা করার আদ্যপ্রান্ত।

যেভাবে হত্যা করা হয় সাইদুল ও সোহেলকে :
ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সোহাগ ব্যাপারী ও ইয়াছিন মোল্লা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধী দেয়। সোহাগ ব্যাপারী দোহার থানার ডুলি হাসির মোড় গ্রামের এমদাদুলের বাসায় থাকতেন। ওই বাসায় থেকে মোটর সাইকেলের মিস্ত্রির কাজ করতেন। সেই সুবাদে এমদাদ, সাজ্জাত মোল্লা, কাওছার মোল্লা, মনির শেখ, ইয়াসিন, আলমদার ও ইয়াসিনের ভাতিজার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। জবানবন্ধীতে সোহাগ ব্যাপারী ম্যাজিস্ট্রেটেটের কাছে বলেন, ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে সাজ্জাত মোল্লা ও এমদাদ আমাকে বলে, আমরা বোটে (ট্রলার) করে মাওয়া ব্রীজ দেখতে যাবো তুমি’কি আমাদের সঙ্গে যাবা? তাদেরকে বলি- আমি যাবো। ঘটনার দিন এমদাদ আমাকে সাজ্জাত মোল্লার বাসায় যেতে বলে। সে আমাকে ৩ হাজার ৫০০টাকা দিয়ে বাঁশতলার আজিমের কাছে যেতে বলে। সেখানে গেলে আজিম টাকা রেখে ৩৫টি ইয়াবা দিয়ে বোটে যেতে বলে। আমি বোটে যাই। সেখানে এমদাদ, আলীমদার, মনির, কাওছাড়, ইয়াসিন ও তার ভাতিজা বসা ছিল। ১০/১২মিনিট পরে সাজ্জাত মোল্লা একটা ব্যাগ ও দুই জন ছেলেকে নিয়ে আসে। তারপর সন্ধ্যার পর বোটে আবার দোহারের দিকে ফিরতে থাকি। ব্রীজ থেকে ৪/৫ কিলোমিটার আসার পর পদ্মা নদীর একটা চরে বোট থামে। বোট থেকে তখন সবাই নেমে ইয়াবা ও মদ খায়।

ম্যাজিস্ট্রেটকে তারা আরও জানায়, পদ্মার চর থেকে সাঈদুল তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানায়, আমি আজ ফিরবো না, আগামীকাল ফিরবো। মদ খাওয়া শেষ হলে প্রথমে রিভলভার দিয়ে সাইদুলের পিঠে গুলি করে, সে পড়ে যায়। এরপর সাজ্জাদ মোল্লা সোহেলের মাথায় নৌকার বইঠা দিয়ে বাড়ি দেয়। তখন এমদাদুল রিভলবার দিয়ে সোহেলকে গুলি করে। এরপর ওরা সবাই মিলে সাঈদুলের গলায় রশি দিয়ে প্যাচ দিয়ে চাপ দেয়। সাঈদুল মারা যায়। তখন ওরা আবার সোহেলের গলায় একইভাবে প্যাচ দিয়ে চাপ দেয়, সোহেলও মারা যায়। এরপর সবাই মিলে বালি খুড়ে গর্ত করে লাশ ২টা লাশ একই গর্তে রেখে বালু দিয়ে চাপা দেয়। এরপর ওই গর্তের বালুর উপরে ডিজেল ঢেলে দেয়।

 

 

আপনি আরও পড়তে পারেন